ধর্মীয় জ্ঞান চর্চার সঙ্গে রমজান মাসের একটি নিবিড় সম্পর্ক আছে। কেননা ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূল উৎস কোরআন রমজান মাসে অবতীর্ণ হয়েছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজান মাসে অধিক পরিমাণ কোরআন তিলাওয়াত করতেন। ফলে রমজান মাসে মুসলিম সমাজে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান চর্চার ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে।

মুসলিম নারীরাও এই পরিমণ্ডলেরই অন্তর্ভুক্ত।
 নারীর জন্য দ্বিন শেখা ফরজ

ইসলাম নারীর জ্ঞানচর্চার অধিকারকে কোনোভাবেই খর্ব করেনি। ইসলামের দৃষ্টিতে প্রয়োজনীয় ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করা মুসলিম নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য ফরজ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন,  ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরজ।


(মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস : ২১৮)


রমজানে ধর্মীয় জ্ঞান চর্চার ঐতিহ্য

প্রাজ্ঞ আলেমরা বলেন, সারা বছর যারা ধর্মীয় জ্ঞান চর্চার সুযোগ পায়, তাদের জন্য রমজানে ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের চেয়ে ইবাদতে মগ্ন হওয়া উত্তম। কিন্তু যারা বছরের অন্য সময় ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পায় না, তারা যদি রমজান উপলক্ষে প্রয়োজনী দ্বিনি শিক্ষা অর্জনের নিয়ত করে, তবে তা প্রশংসনীয়। বহু বুজুর্গ আলেম রমজানে ধর্মীয় জ্ঞান চর্চায় মানুষকে উৎসাহিত করেছেন। এ ছাড়া মুসলিম শাসকরাও রমজানে ধর্মীয় জ্ঞান চর্চা বাড়াতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করতেন।

যেমন তুর্কি সমাজে রমজানে ধর্মীয় আলোচনার রীতি—যা হুজুরে হুমায়ুন ওয়াজ নামে পরিচিত ছিল। রমজানে সুলতানের উপস্থিতিতে প্রাজ্ঞ আলেমরা কোরআনের ব্যাখ্যা করতেন। এই আয়োজনে অংশ গ্রহণ করত ছাত্র ও সাধারণ মানুষ। তারা প্রশ্ন করারও সুযোগ পেত। ইস্তাম্বুলে অবস্থিত উসমানীয় সুলতানের বাসভবন কোপকাপি প্রাসাদে অনুষ্ঠিত হতো।

পৃথক মজলিস আবশ্যক কেন

নারীর স্বভাব-চরিত্রে লজ্জা ও সংকোচ প্রবল, বিশেষ করে নারীদের ব্যক্তিগত বিষয়গুলো তারা আড়াল করতে চায়। তাই নারীর দ্বিনি শিক্ষা নিশ্চিত করতে পৃথক দ্বিনি মজলিস হওয়া উত্তম। রাসুলুল্লাহ (সা.) নারীদের জন্য পৃথক মজলিসের ব্যবস্থা করেছিলেন। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, নারীরা একবার নবী (সা.)-কে বলল, পুরুষরা আপনার কাছে আমাদের চেয়ে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। তাই আপনি নিজে আমাদের জন্য একটি দিন নির্ধারিত করে দিন। তিনি তাদের বিশেষ একটি দিনের অঙ্গীকার করলেন; সেদিন তিনি তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন এবং তাদের উপদেশ দিলেন। তিনি তাদের যা যা বলেছিলেন, তার মধ্যে একথাও ছিল যে তোমাদের মধ্যে যে স্ত্রীলোক তিনটি সন্তান আগেই পাঠাবে, তারা তার জন্য জাহান্নামের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে। তখন জনৈক স্ত্রীলোক বলল, আর দুটি পাঠালে? তিনি বললেন, দুটি পাঠালেও।

(সহিহ বুখারি, হাদিস : ১০১)

যেসব বিষয় প্রাধান্য দেওয়া হবে

নারীদের দ্বিনি শিক্ষার ব্যাপারে দ্বিনি প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ রাখা আবশ্যক। অর্থাৎ ঈমান-আকিদা, ফরজ ও ওয়াজিব বিধি-বিধানকে প্রাধান্য দেওয়া। এরপর নারীদের একান্ত ব্যক্তিগত বিধি-বিধানগুলোর প্রতি লক্ষ রাখা। ঈমান-আকিদা, ফরজ-ওয়াজিব বিধানগুলো ও পবিত্রতাসংক্রান্ত মাসআলাগুলো জানার পর নারীরা মুআমালাত (লেনদেন), মুআশারাত (সামাজিক আচরণ) ও আত্মশুদ্ধি সম্পর্কিত বিধানগুলো জানার চেষ্টা করবে।

(মাদারিজুত তলব)


আয়োজন হতে পারে যেভাবে

নারীদের দ্বিনি শিক্ষার মজলিস নানা আঙ্গিকেই আয়োজন করা যেতে পারে। যেমন—

১. ঘরে দ্বিনি তালিম : ঘরে দ্বিনি তালিম করা গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম ঐতিহ্য। পরিবারের দ্বিনি মনোভাব রক্ষায় তালিম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ পারিবারিক তালিমের পাশাপাশি পরিবারের নারী ও কন্যাশিশুদের জন্য পৃথক তালিমের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। নিম্নোক্ত আয়াত থেকে নারীদের পারিবারিক তালিমের গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর আয়াত ও জ্ঞানের কথা যা তোমাদের ঘরে পঠিত হয়, তা তোমরা স্মরণ রাখবে, আল্লাহ অতি সূক্ষ্মদর্শী, সর্ববিষয়ে অবহিত।’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ৩৪)

২. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হলে মজলিস : সাধারণ ধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দ্বিনি শিক্ষার ব্যবস্থা থাকে না। রমজান উপলক্ষে এসব প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের জন্য দ্বিনি শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারে; যেন তারা ফরজ ইলম থেকে বঞ্চিত না হয়। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের নারী শিক্ষার্থীরা নিজ উদ্যোগে হলে দ্বিনি শিক্ষার আসর করতে পারে। দ্বিন শেখার মাধ্যমে আত্মরক্ষা করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য আবশ্যক। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! তোমরা নিজেদের এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে রক্ষা কোরো জাহান্নামের আগুন থেকে, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর।’

(সুরা : তাহরিম, আয়াত : ৬)

৩. ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অধীনে মজলিস : প্রতিটি অঞ্চলের দ্বিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষ করে মহিলা মাদরাসার অধীনে রমজানসহ বিভিন্ন সময়ে নারীদের দ্বিনি শিক্ষার মজলিস করা আবশ্যক। কেননা সমাজের খুব ক্ষুদ্র অংশই মাদরাসায় দ্বিনি শিক্ষা অর্জন করতে আসে। প্রতিবেশী হিসেবে অন্যদের দ্বিনি শিক্ষার উদ্যোগ নেওয়া তাদের দায়িত্ব। ফকিহ আলেমরা বলেন, সুরা তাহরিমের উল্লিখিত আয়াতে ‘পরিবার-পরিজনের’ ভেতর প্রতিবেশীরাও অন্তর্ভুক্ত।

৪. মহল্লাভিত্তিক মজলিস : নারীদের জন্য মহল্লাভিত্তিক দ্বিনি শিক্ষার মজলিস হতে পারে। তবে তা আল্লাহভীরু আলেমদের অধীনে হওয়া আবশ্যক। নতুবা ফিতনার আশঙ্কা থেকেই যায়। আর এসব মজলিসের আলোচক ধর্মীয় জ্ঞান রাখে এমন নারীদের মাধ্যমেই হওয়া উচিত।

যেসব বিষয়ে সতর্কতা কাম্য

রমজানে নারীদের দ্বিনি শিক্ষার মজলিসের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। তবে এই আয়োজন যেন ফলপ্রসূ হয় এবং কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না হয়, সে জন্য কিছু বিষয়ে লক্ষ রাখা আবশ্যক। যেমন—

১. মজলিসের শিষ্টাচার রক্ষা করা : দ্বিনি মজলিসের যেসব শিষ্টাচার আছে তা রক্ষা করা। যেমন—বিশুদ্ধ নিয়তে অংশ নেওয়া, সালাম দেওয়া, যেখানে সুযোগ হয় সেখানে বসা, মনোযোগসহ আমলের নিয়তে আলোচনা শোনা ইত্যাদি।

২. পর্দা রক্ষা করা : দ্বিনি শিক্ষার আয়োজন যদি ঘর বা সংরক্ষিত এলাকার বাইরে হয়, তবে পূর্ণ পর্দা রক্ষা করে তাতে অংশ নেওয়া আবশ্যক। পর্দা রক্ষা করা ফরজ। পর্দার পরিপন্থী সাজসজ্জা পরিহার করা।

৩. পরচর্চা পরিহার করা : বহু নারীর ভেতর অর্থহীন গল্প ও পরচর্চার প্রবণতা রয়েছে। দ্বিনি শিক্ষার আসরে অংশগ্রহণকারীরা তা পরিহার করবে।

৪. খুব দীর্ঘ না করা : পারিবারিক জীবনের অনেক আয়োজন নারীদের ওপর নির্ভরশীল। তাই দ্বিনি মজলিস খুব দীর্ঘ হলে পরিবারে তার মন্দ প্রভাব পড়তে পারে। প্রয়োজনে অংশগ্রহণকারী নারী স্বামী বা অভিভাবকের সঙ্গে সময়ের ব্যাপারে কথা বলে নিতে পারেন।

৫. জাগতিক লেনদেন পরিহার করা : দ্বিনি শিক্ষার মজলিসে যাবতীয় জাগতিক লেনদেন পরিহার করা আবশ্যক। যেন তা মনোমালিন্যের কারণ না হয় এবং মজলিসের উদ্দেশ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ না করে। (খাওয়াতিন আওয়ার রমজানুল মোবারক, পৃষ্ঠা ৮৩)

আল্লাহ সবাইকে দ্বিন শেখার তাওফিক দিন। আমিন।