যৌনতার ইতিহাসে ভায়াগ্রার আবিষ্কারকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে ধরা হয়, কিন্তু মজার বিষয় হল, এই ওষুধটি আবিষ্কার হয়েছিল দুর্ঘটনাবশত অন্য রোগের ওষুধের পরীক্ষার চালানোর সময়। যে ওষুধটির প্রয়োজনীয়তা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।

ভায়াগ্রা ১৯৯৮ সালে বিক্রি শুরু হয় এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটি সবচেয়ে বেশি বিক্রীত ওষুধে পরিণত হয়।

ঘটনাক্রমে আমেরিকান ওষুধ কোম্পানি ফাইজারের আবিষ্কৃত এই ‘ব্লু পিল’ এখন তাদের বিশাল অর্থ উপার্জনের মেশিনে পরিণত হয়েছে।

শুধুমাত্র প্রথম তিন মাসে, আমেরিকানরা ইরেক্টাইল ডিসফাংশন বা লিঙ্গ শিথিলতা দূর করার এই ওষুধের পেছনে আনুমানিক ৪০ কোটি ডলার খরচ করেছে।

ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি পেলে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলার হতে পারেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি ভায়াগ্রার ‘পোস্টার বয়’ হয়েছিলেন।

খ্রিস্টানদের আধ্যাত্মিক নেতা পোপও ভায়াগ্রার প্রতি তার সমর্থনের কথা ঘোষণা করেছিলেন।

ব্রিটেনের সাউথ ওয়েলসের শিল্প শহর মার্থার টিডওয়েল
ছবির ক্যাপশান,ব্রিটেনের সাউথ ওয়েলসের শিল্প শহর মার্থার টিডওয়েল

শিল্প শ্রমিকদের প্রচেষ্টায় ভায়াগ্রার আবিষ্কার

ভায়াগ্রার ইতিহাসের সাথে ব্রিটেনের সাউথ ওয়েলসের শিল্প শহর মার্থার টিডওয়েলের বড় ধরনের যোগসূত্র রয়েছে।

এই শহরের অনেক পুরুষই ইস্পাত কারখানার শ্রমিক ছিলেন। কিন্তু শিল্প মন্দার সময়, তারা কারখানা ছেড়ে অন্যত্র চাকরি খুঁজতে বাধ্য হন।

এই বেকার শিল্প শ্রমিকদের মধ্যে কেউ কেউ স্থানীয় একটি মেডিকেল সেন্টারের গবেষণা কেন্দ্রে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ নেন।

যাদের ওপরে ভবিষ্যতের বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতির পরীক্ষা চালানো হতো।

তাদের মধ্যে একজন শ্রমিক জানতেন না, তিনি যে চিকিৎসা গবেষণার অংশ হতে চলেছেন তা ইতিহাস তৈরি করতে যাচ্ছে।

প্রায় ৩০ বছর পর তিনি জানতে পারেন, তিনি যে ওষুধের ট্রায়াল বা পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন সেটি লাখ লাখ পুরুষের ইরেক্টাইল ডিসফাংশন বা লিঙ্গ শিথিলতা নিরাময় করেছে।

১৯৯০ এর দশকের গোঁড়ার দিকে, ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ফাইজার সিলডেনাফিল ইউকে ৯০,৪৮০ নামক একটি উপাদান পরীক্ষা করছিল।

উদ্দেশ্য ছিল ওই উপাদান দিয়ে উচ্চ রক্তচাপ এবং এনজিনা বা বুকে ব্যথা নিরাময়ের ওষুধ তৈরি করা।

এজন্য কোম্পানিটি গবেষণা কেন্দ্রে গবেষণা চালায় এবং ওষুধটি পরীক্ষার জন্য শুধুমাত্র কিছু যুবক স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়োগ দেয়।

নতুন ওষুধের ট্রায়ালে অংশগ্রহণকারীদের একজন ছিলেন অ্যাড্রাস প্রাইস।
ছবির ক্যাপশান,নতুন ওষুধের ট্রায়ালে অংশগ্রহণকারীদের একজন ছিলেন অ্যাড্রাস প্রাইস।

হতাশা থেকে আশার আলো

উনিশশো বিরানব্বই সালে এই নতুন ওষুধের ট্রায়ালে অংশগ্রহণকারীদের একজন ছিলেন অ্যাড্রাস প্রাইস। “যখনই আমার টাকার অভাব হতো, আমি সাবমাক নামে ওই গবেষণা কেন্দ্রে যেতাম,” তিনি বলেন।

“সেখানে গিয়ে আমি ম্যানেজমেন্টকে জিজ্ঞেস করতাম যে তিনি অর্থ উপার্জনের জন্য কোন গবেষণায় অংশ নিতে পারবো কিনা।”

“আমাদের ওষুধ সম্পর্কে কিছু বলা হতো না,” তিনি বলেন।

“শুধুমাত্র ডাক্তারই বলতেন যে, এই জাতীয় ওষুধগুলো বুকে ব্যথার চিকিৎসার জন্য এবং এগুলো আমাদের উপর কিছু নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে৷”

“কি ঘটতে চলেছে তা ভেবে অনেকেই চিন্তিত হয়ে পড়তো।”

এই গবেষণার সাথে জড়িত এক বিজ্ঞানী বলেন, গবেষণা চলাকালীন তারা উচ্চ রক্তচাপ প্রশমনে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাননি।

“আমরা খুব হতাশ হয়ে পড়ি এবং মনে হচ্ছিল প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যাবে,” তিনি বলেন।

কিন্তু তারপর একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, শেষ দশ দিন ওষুধটির পরীক্ষা চালানো হবে এবং ফলাফল কী হয় দেখতে স্বেচ্ছাসেবকদের উপর আরও ওষুধ প্রয়োগ করা হবে।

তরুণ স্বেচ্ছাসেবকদের এই ওষুধটি দিনে তিনবার টানা ১০ দিন খেতে বলা হয়।

দুর্ঘটনাবশত আবিষ্কার

বিবিসি ডকুমেন্টারি ‘কিপ ইট আপ’-এ ট্রায়ালে অংশ নেয়া অ্যাড্রাস প্রাইস বলেন, “১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে এবং ৯০-এর দশকের শুরুতে আমাদের জন্য জীবনযাপন খুব কঠিন হয়ে পড়ে।”

“যে কোনো জায়গা থেকে টাকা পাওয়ার জন্য আমরা মরিয়া হয়ে থাকতাম।”

“এই ওষুধ পরীক্ষার অংশ হয়ে আমি যে অর্থ পেয়েছি তা আমার পরিবারের জন্য খুবই জরুরি ছিল কারণ তখন আমাদের কোন চাকরি ছিল না।”

“আমরা এখান থেকে যে অর্থ পেয়েছি তা দিয়ে আমরা বেশি বেশি খাবার এবং পানীয় কিনতে পারতাম এবং আগুন জ্বালানোর জন্য দুই ব্যাগের পরিবর্তে পাঁচ ব্যাগ কয়লা কিনতে পারতাম।”

“এটা ছিল ‘ইজি মানি’ বা সহজভাবে আয় করা পয়সা যা আমাদের বেশ কাজে এসেছিল,” তিনি বলেন।

স্বেচ্ছাসেবীদের মধ্যে, যারা হৃদরোগ, পেশীতে ব্যথা, মাথাব্যথা এবং পেটের সমস্যায় ভুগছিলেন তাদের বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়।

কিন্তু যখন এই ওষুধের পরীক্ষা শেষ হয়, তখন তাদের শরীরে এক অস্বাভাবিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।

এই পরীক্ষার সাথে জড়িত নার্সরাও পর্যবেক্ষণ করেন যে, ওষুধ গ্রহণকারীরা লিঙ্গের উত্থান স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হচ্ছে বলে তাদের জানিয়েছেন।

ফাইজারের সাবেক কর্মচারী ড. পিট এলিসের কাছেও স্বেচ্ছাসেবকরা অভিযোগ জানাতে শুরু করেন।

তারা বলেন যে, “বিষয়টি কিছুটা বিব্রতকর, কিন্তু আমি লক্ষ্য করছি যে আমি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সতর্ক বোধ করছি এবং আমার যৌনাঙ্গের শক্তি আগের চেয়ে বেশি হয়ে গিয়েছে।”

ওষুধটির ধরনের প্রতিক্রিয়া গবেষক দলটির জন্য খুব আশ্চর্যজনক এবং অপ্রত্যাশিত ছিল।

“আটজন স্বেচ্ছাসেবকের মধ্যে পাঁচজনের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেছে, যা আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে যে এটি ওষুধের অস্থায়ী প্রভাবে হয়েছে নাকি আমরা পুরুষদের রোগের প্রতিকার আবিষ্কার করেছি?” বলেন ড. পিটার৷

গবেষণা

গেম চেঞ্জার

পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে, ফাইজার কোম্পানি স্ট্যামিনা বা শারীরিক সামর্থ্যের ওপর নতুন এক গবেষণা চালায়।

ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল শহরের সাউথমিড হাসপাতালে ইরেক্টাইল ডিসফাংশন বা লিঙ্গ শিথিলতায় ভোগা রোগীদের উপর ওষুধটি পরীক্ষা করা হয়।

ব্রিটেনের সোয়ানসি সিটিতে ১৯৯৪ সালে আরো একটি ক্লিনিকাল ট্রায়াল পরিচালিত হয়।

সোয়ানসির মোরেস্টন হাসপাতালে বড় পরিসরে ওষুধটির পরীক্ষামূলক প্রয়োগ চলে। যেখানে এটি ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগীদের উপরও পরীক্ষা করা হয়।

কেননা ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগে আক্রান্তরা তাদের ইরেক্টাইল ডিসফাংশন বা লিঙ্গ শিথিলতা আছে বলে অভিযোগ করেছেন।

এই ট্রায়ালের প্রধান এবং এন্ডোক্রিনোলজি বিশেষজ্ঞ ডেভিড প্রাইস বলেছেন, “ফাইজার জানিয়েছিল এই পরীক্ষা যেন শুধুমাত্র বিষমকামী পুরুষদের ওপর চালানো হয়।”

অর্থাৎ যেসব পুরুষ শুধুমাত্র নারীদের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন (সমকামী নন) এবং যারা কোন নারীর সাথে সম্পর্কের মধ্যে আছেন।

“আমরা ওষুধটি এমন সাধারণ পুরুষদের উপর পরীক্ষা করেছি। তারা মূলত সোয়ানসির ব্লু-কলার জব করা অর্থাৎ শ্রমিক শ্রেণীর বিবাহিত পুরুষ ছিলেন।”

“ট্রায়াল চলাকালে ওই পুরুষদের অশ্লীল ভিডিও দেখানো হয়েছিল,” তিনি বলেন।

ওষুধের প্রভাব পর্যবেক্ষণের জন্য ট্রায়ালে অংশ নেয়া পুরুষদের পুরুষাঙ্গে একটি ডিভাইস বসানো হয়। চিকিৎসকরা স্বেচ্ছাসেবকদের আশ্বস্ত করেছিলেন যারা ট্রায়ালে অংশ নিয়েছেন তাদের কোনও সমস্যা হবে না।

ব্রিস্টল গবেষণার মতো সোয়ানসিতে চালানো একটি পরীক্ষায় ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া যায়।

ফাইজার বুঝতে পেরেছিল যে তাদের হাতে একটি সম্ভাব্য ‘গেম চেঞ্জার’ ওষুধ রয়েছে। যা এই শিল্পে বিপ্লব ঘটাবে।

এক পর্যায়ে স্বেচ্ছসেবকরা ওষুধ ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানায়।
ছবির ক্যাপশান,এক পর্যায়ে স্বেচ্ছসেবকরা ওষুধ ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানায়।

ওষুধ ফেরত দিতে অস্বীকৃতি

ভায়াগ্রার দুর্ঘটনাজনিত আবিষ্কারের দিকে পরিচালিত প্রথম গবেষণাটি ১৯৯২ সালে করা হয়েছিল, কিন্তু সেই আবিষ্কারের পরে, ফাইজার আরও ২১টি পরীক্ষা পরিচালনা করে।

“এই ট্রায়ালগুলো ইরেক্টাইল ডিসফাংশনে ভোগা রোগীদের ওপর চালানো হয় এবং প্রতিটি পরীক্ষায় ওষুধটি কাজ করে, যা আশ্চর্যজনক ছিল।”

“কারণ সাধারণত কোনও পরীক্ষায় শতভাগ সফলতা পাওয়া যায় না,” গবেষক সাইমন ক্যাম্পবেল বলেন।

এই পরীক্ষায় আরেকটি আশ্চর্যজনক বিষয় হল, সাধারণত ট্রায়ালের সময় যখন রোগীদের ওষুধ দেওয়া হয়, তারা অনেক সময় সেই ওষুধ খেতে ভুলে যেতেন।

তবে এই পরীক্ষায় এমন কোনও সমস্যা হয়নি।

ওষুধের ফলাফল এতই ইতিবাচক ছিল যে পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী অনেক পুরুষ স্বেচ্ছাসেবক তাদের অব্যবহৃত ওষুধগুলো ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানায়।