কর্জে হাসানা বা উত্তম ঋণ অতি পুণ্যময় একটি আমল। এটি মানবতার কল্যাণে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনকারী। ঋণদাতা কোরআন-হাদিসের দৃষ্টিতে অতি ভাগ্যবান মানুষ। আবু হুরায়রা (রা.)-এর বর্ণনায় মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, ‘এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই।

সে তার ওপর কোনো জুলুম করে না। তার সাহায্য ত্যাগ করে না। যে তার মুসলিম ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণে থাকে, আল্লাহ তার প্রয়োজন পূরণে থাকেন। আর যেকোনো মুসলমানের একটি বিপদ দূর করবে, আল্লাহ তাআলা তার কিয়ামতের দিনের বিপদগুলো থেকে একটি বিপদ দূর করে দেবেন।’ (বুখারি, হাদিস : ২৪৪২; মুসলিম, হাদিস : ২৫৮০)অন্য এক হাদিসে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘কোনো একজন মুসলমান অন্য মুসলমানকে একবার ঋণ দিলে এ ঋণদান আল্লাহর রাস্তায় সে পরিমাণ সম্পদ দুইবার সদকা করার সমতুল্য হয়।’ (মাআরিফুল কুরআন, সংক্ষিপ্ত, সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৪৫)

ইসলামে ঋণ দেওয়া পুণ্যময় একটি কাজ। ঋণগ্রহীতা ঋণ আদায়ে অক্ষম হলে তা মাফ করে দেওয়া আরো বেশি সওয়াবের কাজ। আবার দুনিয়ায় এমন মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়, যারা ঋণ নেওয়ার পর তা আদায়ের কথা বেমালুম ভুলে যায়।

অনেকেই আবার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ঘোরাতে ঘোরাতে ঋণদাতার বারোটা বাজিয়ে দেয়। কেউ কেউ পুরো টাকা মেরে দেয়। অনেক ক্ষেত্রে আহত-নিহত হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে। ফলে মানুষের মনে কর্জে হাসানার ব্যাপারে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। তাই এসব ফটকাবাজের কারণে সমাজের ভালো মানুষগুলো বিপদের সময় কর্জে হাসানা পায় না।

অথচ ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতা উভয় শ্রেণির জন্য ইসলামে আছে বিশেষ নির্দেশনা। এসব নির্দেশনা মেনে চললে অনাকাঙ্ক্ষিত সংকট দূর হবে, ইনশাআল্লাহ।

ঋণগ্রহীতার দায়িত্ব ও কর্তব্য

১. ঋণগ্রহীতার এ কথা সর্বদাই মাথায় রাখা উচিত যে ঋণগ্রস্ততা অনেক সময় দুশ্চিন্তা ও অশান্তির কারণ হয়। এ জন্য মানুষের কর্তব্য হলো- আল্লাহর কাছে ঋণ গ্রহণ থেকে পানাহ চাওয়া এবং দোয়া করা—তিনি যেন ঋণ গ্রহণ ছাড়াই তার সব প্রয়োজন পূরণ করে দেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর কাছে ঋণ গ্রহণ থেকে আল্লাহর আশ্রয় চেয়ে দোয়া করতেন। (বুখারি, হাদিস : ৮৩২)

২. ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে বাস্তবিকই প্রয়োজন আছে কি না, থাকলে সেটা কোন পর্যায়ের, ঋণ গ্রহণ ছাড়া অন্য কোনোভাবে তা পূরণ করা সম্ভব কি না এবং ঋণ গ্রহণ করলে সময়মতো তা পরিশোধ করা যাবে কি না—এই বিষয়গুলো বিবেচনা করা খুবই জরুরি। বিশেষ প্রয়োজন ও সময়মতো পরিশোধের প্রবল ধারণা ছাড়া ঋণ গ্রহণ জায়েজ নয়।

৩. সময়মতো পরিশোধের পাক্কা নিয়ত থাকা এবং এর জন্য চেষ্টা অব্যাহত রাখা জরুরি। আর পরিশোধের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকা। কিন্তু ঋণ নেওয়ার সময়ই পরিশোধ না করার নিয়ত রাখা বা ঋণ নেওয়ার পর সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে পড়া খুব অন্যায় ও গুনাহের কাজ। আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি মানুষের সম্পদ পরিশোধের নিয়তে ঋণ নেয়, আল্লাহ তাআলা তাঁর পক্ষ থেকে পরিশোধ করে দেন। আর যে আত্মসাতের উদ্দেশ্যে নেয়, আল্লাহ তা ধ্বংস করে দেন। (বুখারি, হাদিস : ২৩৮৭)

৪. নির্ধারিত সময়ের আগেই ঋণ পরিশোধের চেষ্টা করা। না পারলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অবশ্যই পরিশোধ করবে। টালবাহানা, মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া, ছলচাতুরী করার কোনোই অবকাশ নেই। আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, (ঋণ আদায়ে) বিত্তবানের টালবাহানা জুলুম। (বুখারি, হাদিস : ২৪০০)

৫. সময়মতো ঋণ পরিশোধ না করলে ঋণদাতা থেকে কখনো কষ্টদায়ক আচরণ প্রকাশ পেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ধৈর্য ধরা ও পাল্টা জবাব না দেওয়া উচিত। কোনো ওজর থাকলে নম্রভাবে বুঝিয়ে বলা উচিত। একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) এক ব্যক্তি থেকে একটি উটনি ঋণ নিয়েছিলেন। সে তা চাইতে এসে কঠোর ব্যবহার করল। তখন উপস্থিত সাহাবারা তার সঙ্গে অনুরূপ ব্যবহার করতে চাইলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাদের বাধা দিয়ে বললেন, ‘তাকে বলতে দাও। পাওনাদারের কিছু বলার অধিকার আছে।’ (বুখারি, হাদিস : ২৩৯০)

৬.  ঋণ বান্দার হক, যা পরিশোধ করা জরুরি, অন্যথায় দাতার কাছ থেকে মাফ নিতে হবে। এ ছাড়া মুক্তির কোনো পথ নেই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঋণ পরিশোধ করে দেওয়া উত্তম। মৃত্যুর আগে তো অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে। পরিশোধের আগেই যদি কারো মৃত্যু এসে যায়, তবে কাউকে অসিয়ত করে যাওয়া আবশ্যক। আশা করা যায়, এতে সে মাফ পাবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘ঋণ ছাড়া শহীদের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।’ (মুসলিম, হাদিস : ১৮৮৬)

ঋণদাতার দায়িত্ব

ঋণের ক্ষেত্রে ঋণদাতারও কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে। নিম্নে তা উল্লেখ করা হলো—

১. একান্ত ঠেকায় পড়ে কেউ কর্জ চাইলে সামর্থ্য থাকলে ঋণ দেবে। কারণ ঋণ দেওয়া মূলত মুখাপেক্ষীকে সাহায্য করা। এ জন্য কোরআন-হাদিসে মুখাপেক্ষী ও বিপদগ্রস্তকে সাহায্য করার যে সওয়াব ও ফজিলত বর্ণিত হয়েছে, তা এখানেও প্রযোজ্য হবে।

২. সময়মতো ঋণ পরিশোধে ঋণগ্রহীতা অক্ষম হলে সুযোগ ও সামর্থ্য থাকলে বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে সচ্ছলতা আসা পর্যন্ত সময় দেওয়া বা মাফ করে দেওয়া অনেক বড় সওয়াবের কাজ। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি অক্ষমকে সুযোগ দেয় বা আংশিক ঋণ কমিয়ে দেয়, আল্লাহ তাআলা তাকে কিয়ামতের দিন তাঁর আরশের ছায়াতলে জায়গা দেবেন, যেদিন আরশের ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না।’  (তিরমিজি, হাদিস : ১৩০৬)

৩. ঋণ তলবের সময় নম্রতা ও ভদ্রতার পরিচয় দেওয়া কর্তব্য। কঠোরতা, গালাগাল, ঝগড়া-বিবাদ ইত্যাদি থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা উচিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ ওই ব্যক্তির ওপর রহমত নাজিল করুন, যে সুহৃদয় যখন বিক্রি করে, যখন ক্রয় করে এবং যখন নিজের হক তলব করে।’ (বুখারি, হাদিস : ২০৭৬)

৪. ভোগ্য ঋণ হোক বা ব্যবসায়ী ঋণ, মূলধনের অতিরিক্ত কোনো কিছুর শর্ত করা যাবে না। কারণ এটা সুদ। এরূপ কেউ করে ফেললে যথানিয়মে তাওবা করে কেবল মূলধনই গ্রহণ করবে। বাড়তিটা গ্রহণ করবে না।

৫. খোটা দিয়ে বা অন্য কোনোভাবে ঋণগ্রহীতাকে কষ্ট না দেওয়া। কারণ এতে ঋণদানের যে সওয়াব তা নষ্ট হয়ে যায়। এ জাতীয় অভ্যাস কারো থাকলে তা পরিহার করা অবশ্য কর্তব্য। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা, তোমরা খোটা ও কষ্ট দিয়ে নিজেদের সদকাকে সে ব্যক্তির মতো নষ্ট করো না, যে নিজের সম্পদ ব্যয় করে মানুষকে দেখানোর জন্য এবং আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৬৪)