আমাদের প্রতিদিনের আমল মূলত একটি পাত্রের মতো। পাত্রের নিচের অংশ যদি মজবুত ও অক্ষত থাকে, তাহলে পাত্রের ভেতরের মালপত্র নিরাপদ থাকে। ঠিক তেমনি আমাদের আমল যদি একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হয়, তাহলে সেগুলো আমাদের আখিরাতের মুক্তির পাথেয় হবে। এক বর্ণনায় আল্লাহর রাসুল (সা.) আমলকে পাত্রের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, ‘আমল হলো পাত্রের মতো।
পাত্রের তলা অক্ষত থাকলে তার উপরিভাগও অক্ষত থাকে এবং তার তলা নষ্ট হয়ে গেলে তার উপরিভাগও নষ্ট হয়ে যায়।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪১৯৯)।উপরোক্ত হাদিসে আমলকে একটি পরিপূর্ণ পাত্রের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। কারণ আমল মূলত নিরাপদ ও অক্ষত থাকে নিয়তের শুদ্ধতা ও অশুদ্ধতার ওপর নির্ভর করে। যেহেতু আমল শুদ্ধ হওয়ার প্রধান শর্ত হলো ইখলাস তথা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রত্যাশা থাকা, তাই একে পাত্রের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।তা ছাড়া ইখলাসের মাধ্যমে আমলে নুর সৃষ্টি হয়। বিপরীতে আমলে যখন সুনাম-সুখ্যাতি ও লোক-দেখানো মনোভাব তৈরি হয়, তখন আমল অন্ধকার ঢেকে যায়; যা শুধু বিশেষ দৃষ্টিপ্রাপ্ত ও প্রকৃত মুমিনরাই বুঝতে পারেন। যেমনিভাবে পাত্রের তলা অক্ষত থাকলে তার মধ্যকার বস্তুগুলো সুরক্ষিত থাকে, কখনো নষ্ট হয় না বা ঝরে পড়ে না। অন্যদিকে পাত্রের তলা নষ্ট হয়ে গেলে তার মধ্যকার বস্তুগুলোও নষ্ট হয়ে যায়।
ঠিক তেমনি মানুষের আমলের অভ্যন্তরীণ দিক তথা নিয়ত ঠিক হলে আমলও সুরক্ষিত থাকে। আবার তার ভেতরের দিক তথা নিয়তে কোনো সমস্যা থাকলে তার আমলের কবুলিয়্যাতেও (আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য) সমস্যা হয়। এক বর্ণনায় এসেছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কাজ (এর প্রাপ্য হবে) নিয়ত অনুযায়ী। আর মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী প্রতিফল পাবে। তাই যার হিজরত হবে ইহকাল লাভের অথবা কোনো মহিলাকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে—তবে তার হিজরত সে উদ্দেশ্যেই হবে, যে জন্য সে হিজরত করেছে। ’(বুখারি, হাদিস : ১)।
তাই বান্দার ওপর আবশ্যক হলো সব কাজে আখিরাতের জীবনকে মুখ্য উদ্দেশ্য বানানো। নিজের মন ও ভাবনাকে রিয়া বা শিরকে আসগর থেকে মুক্ত রাখা। এদিকে ইঙ্গিত করে নবী করিম (সা.) বলেন, ‘পার্থিব চিন্তা যাকে মোহগ্রস্ত করবে, আল্লাহ তার কাজকর্মে অস্থিরতা সৃষ্টি করবেন, দরিদ্রতা তার নিত্যসঙ্গী হবে এবং পার্থিব স্বার্থ ততটুকুই লাভ করতে পারবে, যতটুকু তার তকদিরে লিপিবদ্ধ আছে। আর যার উদ্দেশ্য হবে আখিরাত, আল্লাহ তার সব কিছু সুষ্ঠু করে দেবেন, তার অন্তরকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করবেন এবং দুনিয়া স্বয়ং তার সামনে এসে হাজির হবে।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪১০৫)।
নিয়তের একটি বিশেষ মাহাত্ম্য হলো- আমল না করতে পারলেও বান্দা শুধু আন্তরিক খাঁটি নিয়তের কারণে সওয়াব লাভ করে। যেমনটি তাবুকের যুদ্ধে ঘটেছে, আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) তাবুক যুদ্ধ থেকে ফিরে মদিনার নিকটবর্তী হলেন, তখন তিনি বললেন, মদিনায় এমন সম্প্রদায় রয়েছে যে তোমরা এমন কোনো দূরপথ ভ্রমণ করোনি এবং এমন কোনো উপত্যকা অতিক্রম করোনি, যেখানে তারা তোমাদের সঙ্গে ছিল না। সাহাবায়ে কিরাম (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! তারা তো মদিনায় ছিল। তখন তিনি বললেন, তারা মদিনায়ই ছিল, তবে যথার্থ ওজর (বিশেষ সমস্যা) তাদের আটকে রেখেছিল। (বুখারি, হাদিস : ৪৪২৩)
ইমাম গাজালি (রহ.) বলেন, মানুষের বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমলের শুদ্ধ ও নষ্ট হওয়া অভ্যন্তরীণ চালিকাশক্তি তথা কলবের অনুভূতির সঙ্গে সংযুক্ত। যেমন-ইখলাস, রিয়া, আত্মতুষ্টি ইত্যাদি। যে ব্যক্তি এই চালিকাশক্তিকে চিনতে পারে না, তার আমলে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে বিপর্যয়মুক্ত আমল করার তাওফিক দান করুন।