জিলকদ মাসকে আরবিতে ‘জিলকদ’ বা ‘জুলকদ’ বলা হয়। জুলকদ দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। এক. জু, দুই. কদাহ। জু মানে হলো ওয়ালা, বিশিষ্ট, অধিকারী আর কদাহ মানে হলো বৈঠক, আসন, উপবেশন ইত্যাদি।(আল মিসবাহুল মুনির, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-৫১০)
নামকরণের কারণজাহিলিয়াতের যুগে আরবরা এ মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ করাকে হারাম মনে করত এবং অস্ত্র সমর্পণ করত। কেউ কাউকে হত্যা করত না, এমনকি পিতা-পুত্রের হত্যাকারীকেও এ মাসে কিছু বলা হতো না। যেহেতু ওই ব্যক্তিরা এ মাসে হত্যা ও প্রতিশোধ নেওয়া থেকে বিচ্ছিন্নভাবে বিরত ও বসে থাকত, তাই এ মাসের নাম দেওয়া হয়েছে ‘জুলকদ’ অর্থাৎ বসে থাকার মাস। (তাফসিরে তাবারি, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-৫৭৯)
জিলকদ মাসের বৈশিষ্ট্য
চারটি মহিমান্বিত মাসের মধ্যে জিলকদ
অন্যতম : আল্লাহ তাআলা যে চারটি মাসকে ‘আশহুরে হুরুম’ অর্থাৎ হারাম মাস হিসেবে ঘোষণা করেছেন তার মধ্যে জিলকদ অন্যতম।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে আল্লাহর কিতাবে (অর্থাৎ লাওহে মাহফুজে) মাসের সংখ্যা ১২। সেই দিন থেকে, যেদিন আল্লাহ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন। এর মধ্যে চারটি মাস মর্যাদাপূর্ণ।’
(সুরা : আত-তাওবা, আয়াত : ৩৬)
১২ মাসে এক বছর।
এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। তিনটি ধারাবাহিক : জিলকদ, জিলহজ, মহররম আর চতুর্থটি হলো রজব, যা জুমাদাল উখরা ও শাবান মাসের মধ্যবর্তী মাস। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৪৬৬২; সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৪৪০৬)
আশহুরে হুরুম বলার কারণ : জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব মাসকে আশহুরে হুরুম বা হারাম মাস বলা হয়। এর কারণ হলো—এক. এ মাসগুলোতে হত্যা করা ও প্রতিশোধ নেওয়া হারাম। দুই. যেহেতু এ মাসগুলো বরকতময় ও সম্মানিত, সে জন্য এ মাসগুলোতে ইবাদতের সওয়াবও বেশি।
তবে তাদের মধ্যে প্রথম হুকুমটি ইসলামে রহিত হয়ে গেছে আর দ্বিতীয় আদেশ এখনো বলবৎ আছে। (মাআরিফুল কুরআন, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-৩৭২)
জিলকদ হজের প্রস্তুতির দ্বিতীয় মাস : আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘হজের নির্দিষ্ট কয়েকটি মাস আছে।’ (সুরা : আল বাকারাহ, আয়াত : ১৯৭)
উলামায়ে কিরাম একমত যে আশহুরে হজ তথা হজের তিনটি মাস আছে, যার মধ্যে প্রথমটি হলো শাওয়াল, দ্বিতীয়টি হলো জিলকদ এবং তৃতীয়টি হলো জিলহজের ১০ দিন। (ফাতহুল বারি, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-৪২০)
হজরত উমর, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর, হজরত আলী, হজরত ইবনে মাসউদ, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা.) প্রমুখ সাহাবি থেকে এটিই বর্ণিত হয়েছে এবং এটি বেশির ভাগ তাবেনেরও মতামত। (লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা-৪৭১)
এ বিষয়টিও জিলকদ মাসের মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠত্ব আরো বাড়িয়ে দিয়েছে যে হজের মধ্যবর্তী মাস। আর আজও বেশির ভাগ মানুষ এই মাস থেকেই হজের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন এবং হজের উদ্দেশ্যে রওনা হন।
জিলকদ মাসে মুসা (আ.) তুর পাহাড়ে ইতিকাফ
করেছেন : যে ৩০ দিন ও ১০ দিনের ওয়াদা আল্লাহ তাআলা মুসা (আ.)-কে দিয়েছিলেন, সেই ৩০টি দিন ছিল জিলকদ মাসে এবং ১০ দিন ছিল জিলহজ মাসে। (লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা-২৫৬)
রাসুলুল্লাহ (সা.) সব ওমরাহ আদায় করেছেন জিলকদ মাসে : রাসুল (সা.) তাঁর সব ওমরাহ জিলকদ মাসে আদায় করেছেন। শুধু শেষ ওমরাহ ছাড়া, তিনি তা হজের মাসে আদায় করেছিলেন। তবে তার ইহরাম তিনি জিলকদ মাসে বেঁধেছিলন, যেমনটি সুনানে আবি দাউদের রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) চারবার ওমরাহ করেছেন। প্রথমবার হুদাইবিয়ার সময়, দ্বিতীয় ওমরাহর পরবর্তী বছর, যেটির ওপর তাদের সঙ্গে সন্ধি হয়েছিল। তৃতীয় ওমরাহ জিরানা নামক স্থান থেকে এবং চতুর্থ ওমরাহ তাঁর হজের সঙ্গে। (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ১৯৯৩)
অন্য হাদিসে তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) জিলকদ মাসেই ওমরাহ করেছেন।
(সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৯৯৬)
রাসুলুল্লাহ (সা.) এই মাসটিকে ওমরাহর জন্য কেন নির্দিষ্ট করেছেন : উলামায়ে কিরাম বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) জিলকদ মাসে এ জন্য ওমরাহ পালন করেছেন, যাতে মানুষ এ মাসের শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে অবগত হয় আর জাহিলিয়াত সম্প্রদায়ের বিরোধিতাও যেন হয়, কারণ তারা এ মাসে ওমরাহ করাকে বড় গুনাহ মনে করত। সে জন্যই রাসুলুল্লাহ (সা.) এ মাসে ধারাবাহিকভাবে ওমরাহ পালন করেছেন, যাতে লোকেরা এর হাকিকত ও বৈধতা বুঝতে পারে এবং জাহিলিয়াতের যুগের প্রভাব তাদের মন থেকে যেন সম্পূর্ণরূপে দূর হয়ে যায়।
(শারহুন নববী, খণ্ড-৮, পৃষ্ঠা-২৩৬)
জিলকদ মাসে রোজা রাখা : জিলকদ ও বাকি আশহুরে হুরুম তথা হারাম মাসগুলোতে নফল রোজা রাখা একটি ফজিলতপূর্ণ আমল।
বাহিলিয়্যাহ গোত্রীয় মুজিবা নামের এক মহিলা থেকে তাঁর পিতা বা চাচা থেকে বর্ণিত, একদা তিনি (পিতা অথবা চাচা) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে দেখা করে চলে যান। অতঃপর এক বছর পরে তিনি আসেন। তখন তাঁর মারাত্মক স্বাস্থ্যহানি ঘটেছিল। তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি কি আমাকে চিনতে পারেননি? তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে? তিনি বলেন, আমি ওই বাহিলি, আমি গত বছর এসেছিলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী কারণে তোমার এরূপ পরিবর্তন ঘটল, অথচ তুমি তো সুন্দর স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলে? তিনি বললেন, আমি আপনার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার পর থেকে রাত ছাড়া আহার করিনি (দিনে অনবরত রোজা রেখেছি)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তুমি তোমার নফসকে কেন এরূপ কষ্ট দিয়েছ? অতঃপর রাসুল (সা.) বলেন, ধৈর্যের মাস (রমজান) এবং প্রতি মাসে একটি করে রোজা রাখো। তিনি বলেন, আমাকে আরো বাড়িয়ে দিন, কেননা আমার সামর্থ্য আছে। তিনি বলেন, দুদিন রোজা রাখো। লোকটি বলল, আরো বাড়িয়ে দিন। তিনি বলেন, (প্রতি মাসে) তিন দিন রোজা রাখো। লোকটি বলল, আরো বাড়িয়ে দিন। তিনি বলেন, তুমি হারাম মাসগুলোতে রোজা রাখো এবং রোজা বর্জনও করো। তুমি হারাম মাসগুলোতে রোজা রাখো এবং রোজা বর্জনও করো। তুমি হারাম মাসগুলোতে রোজা রাখো এবং রোজা বর্জনও করো। এ কথা বলে তিনি তিনটি আঙুল একত্র করার পর ফাঁক করে দিলেন। (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ২৪২৮)
ফায়দা
মুহাদ্দিসগণ লিখেছেন, তিন আঙুল দ্বারা ইশারা করার অর্থ হলো যতবার ইচ্ছা ততবার রোজা রাখবে, কিন্তু একটানা তিন দিন রোজা রাখার পর এক বা দুই দিন বাদ দেবে।
কোনো কোনো মুহাদ্দিস বলেছেন যে এর অর্থ আশহুরে হুরুমে তিন দিন রোজা রাখা এবং তিন দিন ছেড়ে দেওয়া, তারপর তিন দিন রোজা রাখা এবং তিন দিন ছেড়ে দেওয়া, তারপর তিন দিন রোজা রাখা এবং তিন দিন ছেড়ে দেওয়া আর এটিই উত্তম। (আওনুল মাবুদ, খণ্ড-৭, পৃষ্ঠা-৫৮)
এ হাদিসের পরিপ্রেক্ষিতে ফকিহগণ এই চার মাসে নফল রোজা রাখা মুস্তাহাব বলেছেন। (আল মাউসুআতুল ফিকহিয়্যাহ আল কুয়েতিয়্যাহ, খণ্ড-২৮, পৃষ্ঠা-৯৫)
জিলকদ মাসে ইবাদতের শ্রেষ্ঠত্ব ও খারাপ কাজের গুনাহের আধিক্য : জিলকদ ও অন্যান্য হারাম মাসে নেক আমল করা অন্যান্য মাসের তুলনায় অধিকতর উত্তম এবং এ মাসে গুনাহ করা অন্যান্য মাসের তুলনায় অধিকতর কঠিন গুনাহ।
ইমাম আবু বকর আল-জাসসাস (রহ.) লিখেছেন : যে ব্যক্তি এই বরকতময় মাসগুলোতে ইবাদত করে, তার অন্যান্য মাসেও ইবাদত করার তাওফিক হয়। আর যে ব্যক্তি এই মাসগুলোতে গুনাহ থেকে বাঁচার চেষ্টা করে, তার জন্য বছরের বাকি মাসে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা সহজ হয়ে যায়। (আহকামুল কুরআন, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-৩০৮)
তাই এ মাসগুলোতে ইবাদত করার চেষ্টা করতে হবে এবং গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে হবে।