বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

১৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৪তম জন্মবার্ষিকী ও ১০৫তম জন্মদিন। বড় অল্প বয়সে আমরা বাংলাদেশের পিতাকে হারিয়েছি, জনককে হারিয়েছি। মাত্র ৫৫ বছর বয়সে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আরও কিছুদিন থাকলে কার কী তেমন ক্ষতি হতো। তিনি থাকলে দেশ ধাক ধাক করে আরও অনেক বেশি উন্নতির শিখরে আরোহণ করত। আজ সারা পৃথিবীতে আমাদের যে অবস্থান তার চেয়ে অনেক বেশি সুদৃঢ় হতো। আমরা বিশ্ব শান্তি সমৃদ্ধিতে অনেক বেশি ভূমিকা রাখতে পারতাম। বাংলাদেশ হতো সারা বিশ্বের প্রগতিশীল মানুষের কণ্ঠস্বর। কিন্তু পিতাকে হারিয়ে আমরা প্রায় সব হারিয়েছি। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে দেশ অবশ্যই টিকে আছে। কিন্তু যে দেশের আন্তর্জাতিক মর্যাদা থাকার কথা ছিল চন্দ্রের স্নিগ্ধ আলোর চেয়ে মায়াময়, সূর্যের মতো উজ্জ্বল সেই দেশের অবস্থা মোটেই তেমনটি নেই। পশ্চিম পাকিস্তানি বঞ্চনার বিরুদ্ধে টুুঙ্গিপাড়ার এক অজপাড়াগাঁ থেকে উঠে আসা এক মহামানব, যিনি আমাদের দুর্বার সাহসী করেছিলেন, আত্মমর্যাদাশীল করেছিলেন। যে যাই বলুক, এখন আমাদের সেই মর্যাদাবোধ নেই, আত্মবিশ্বাস নেই, ন্যায়-নীতির কোনো তোয়াক্কা নেই। যা আমরা অর্জন করেছিলাম তা প্রায় সব খুইয়ে ফেলেছি। আমাদের সর্বাধুনিক গাড়ি-ঘোড়া আছে, রাস্তাঘাট আছে, আছে দালানকোঠা। কিন্তু সমুদ্রের চেয়ে বিশাল প্রগাঢ় আমাদের যে হৃদয় ছিল তা কেমন যেন একেবারে সংকীর্ণ হয়ে এসেছে, ছোট হয়ে এসেছে। আমাদের মানবতা, আমাদের ভালোবাসা, আমাদের দেশপ্রেম ছিল সারা জগৎকে নাড়া দেওয়ার মতো। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে খুদিরাম ফাঁসিতে জীবন দিয়েছে। কিন্তু নতি স্বীকার করেনি। ব্যারাকপুরে ইংরেজকে অস্বীকার করে মঙ্গল পান্ডে সিপাহি বিপ্লবের সূচনা করেছিল, ইংরেজ তার অস্ত্রবলে ১৮৫৮ সালের সিপাহি বিপ্লব প্রতিহত করেছিল সত্য, কিন্তু দেশবাসীর মন ও মনন থেকে স্বাধীনতা বা মুক্তির আকাক্সক্ষাকে পরাভূত করতে পারেনি। ব্রিটিশ তাড়িয়ে আমরা পাকিস্তানের অংশ হয়েছিলাম। ১৫০০ কিলোমিটার দূরের পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের কোনো কিছুতেই মিল ছিল না। পাকিস্তানি নেতারা আমাদের সঙ্গে এত তঞ্চকতা করেছিল যেখানে পূর্ব পাকিস্তানকে সবদিক থেকে বঞ্চিত করা হতো। আসাম, মেঘালয়, পশ্চিমবঙ্গের অনেকটাই থাকার কথা ছিল আমাদের। আজকের মিয়ানমার রোহিঙ্গা সমস্যা সেটা সে সময় পাকিস্তানি নেতাদের উদাসীনতার এক চরম স্বাক্ষর। না হলে আরাকান আমাদের থাকত। শত শত বছর আমাদের সঙ্গে ছিল। পাকিস্তান সৃষ্টির কয়েক বছরে দেখা গেল পাকিস্তানের অর্থনীতির আমরা জোগান দিই ৬০-৭০ ভাগ আর পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হয় ৭০-৮০ ভাগ, আমরা হই বঞ্চিত। পশ্চিম পাকিস্তান আমাদের থেকে পাঁচ গুণ বড়। কিন্তু লোকসংখ্যা অনেক কম। ফসলি জমি নেই বলতেই চলে। মরুভূমি আর পাহাড়-পর্বতে ঘেরা পশ্চিম পাকিস্তান। আমরা পাট ফলাতাম, বৈদেশিক মুদ্রার ১২ আনা উপার্জন করতাম আমরা। পাকিস্তানিরা খরচ করত আমদের থেকে চার গুণ। অফিস-আদালতে সব বড় বড় কর্মকর্তা ওরা, আমরা পিয়ন চাপরাশি। রাষ্ট্র চলেছিল একনায়কতন্ত্রের মাধ্যমে। শেষাব্দি ’৭০-এ মানুষের গণতান্ত্রিক রায়কেও তারা মানেনি। যে কারণে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে হয়েছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোথাও এর নজির নেই যে একটি নিরস্ত্র গণতান্ত্রিক সংগঠন এত তাড়াতাড়ি সশস্ত্র রূপ নিতে পারে। নেতা পিতার প্রতি আমাদের গভীর আস্থা ছিল বলে আমরা কলম ছেড়ে বাঁশের লাঠি আর সেই বাঁশের লাঠি একসময় কামান-বন্দুক হয়ে যায়। এতটা ছিল আমাদের নেতার নেতৃত্ব কর্তৃত্ব। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা থাকে, ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর প্রতি বাংলাদেশের, পিতার প্রতি আমাদের যে ভালোবাসা সৃষ্টি হয়েছিল সেটা অতুলনীয়। তখনকার সাড়ে ৭ কোটি বাঙালির মধ্যে ৫-৬ কোটি বাঙালি যতবার নামাজ পড়েছে নিজের আত্মীয়স্বজন, পিতা-মাতা, বন্ধু-বান্ধবের জন্য আল্লাহর কাছে মাগফিরাত কামনা করেছে ততবার বঙ্গবন্ধুর জন্যও করেছে। বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু আর স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু আর মুক্তিযুদ্ধ একাকার হয়ে গিয়েছিল। কোনো কিছু থেকে বঙ্গবন্ধুকে আলাদা করার সুযোগ ছিল না।

এটা সত্য, আমরা পাকিস্তান হানাদারদের কাছ থেকে নিশ্চয়ই ভূখণ্ড স্বাধীন করেছি, আলাদা করেছি। কিন্তু আমরা মুক্তি অর্জন করতে পারিনি। সেটা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানবিক অথবা ন্যায়বিচার এসব কোনো ক্ষেত্রেই আমাদের জাতীয় মুক্তি আসেনি বা অর্জন করতে পারিনি। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা পাকিস্তানের চেয়ে পিছিয়ে পড়েছি। যে ন্যায় ও সত্যের জন্য বাংলাদেশের পিতা বঙ্গবন্ধু সারা জীবন লড়াই করেছেন সেই ন্যায় ও সত্য থেকে আমরা অনেক দূর সরে গেছি। আমাদের নীতিবোধ সততা যে দৃঢ়ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে ছিল তা এক ফুঁৎকারে কেন যেন কোথায় হারিয়ে যেতে বসেছে। নির্বিবাদী সৎ সহজ সরল মানুষ সমাজে পেছনে পড়ে যাচ্ছে। কোর্ট কাচারি আইন-আদালত সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই সত্যের দৃঢ় ভিত প্রায় ধসে পড়েছে। যেটা ছিল বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের সাধনা। ইদানীং শুধু বঙ্গবন্ধুকে নিয়েই বর্তমান তথাকথিত কিছু অনুসারী কথা বলে। তিনি যাদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে এগিয়ে গিয়েছিলেন তাদেরও অবমূল্যায়ন করা হয়। বিশেষ করে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বর্ধমানের আবুল হাশেম, জননেতা শামসুল হকসহ আরও আরও যারা শেখ মুজিবুর রহমানকে পথ দেখিয়ে এগিয়ে এনেছেন তাঁরা প্রায় সবাই গুরুত্বহীন। অন্যদিকে যাদের দুর্বার প্রচেষ্টায় টুঙ্গিপাড়ার শেখ লুৎফর রহমানের ছেলে শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধু হয়েছেন, জাতির পিতা হয়েছেন তারাও কেমন যেন একেবারে অবহেলিত অনাদ্রিত। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক তোফায়েল আহমেদ, অন্যদিকে এ কে এম ওবায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, নীলফামারীর আবদুর রউফ, নোয়াখালীর খালেদ মোহাম্মদ আলী, চট্টগ্রামের এস এম ইউসুফ, ফেরদৌস আহমেদ কোরাইশী, ফজলুল করিম মিঠু, আল মুজাহিদী, ফজলুর রহমান ফারুক, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, বুলবুল খান মাহাবুব এমনি শতাধিক তরুণ তুর্কি না হলে টুঙ্গিপাড়ার শেখ লুৎফর রহমানের ছেলে জাতির পিতা হতেন না, বঙ্গবন্ধু হতেন না। তাঁদেরও কীভাবে কীভাবে যেন প্রতি মুহূর্তে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে। দশের চক্রে ভগবান ভূতের মতো যারা সারা জীবন বঙ্গবন্ধুকে জ্বালিয়েছে  তারা আমার বোনের ছায়ায় আমাদের জীবনের ওপর কাঠি নাড়াচ্ছে।নেতা পিতার এক কথায় জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। আল্লাহ দয়া করেছিলেন, ক্ষত-বিক্ষত দেহে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলাম। স্বাধীন বাংলাদেশে রাজধানীর বাইরে পিতা একমাত্র টাঙ্গাইলে এসেছিলেন কাদেরিয়া বাহিনীর হাত থেকে অস্ত্র তুলে নিতে। ’৭২-এর ২৪ জানুয়ারি যেদিন আমরা পিতার পায়ের কাছে অস্ত্র বিছিয়ে দিয়েছিলাম সেদিন টাঙ্গাইল ওয়াপদা ডাকবাংলোয় সোভিয়েত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আন্দ্রে ফোমিন সোভিয়েত রাশিয়ার পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পৌঁছে দিতে এসেছিলেন। তাকে নিয়ে আমরা একত্রে খেয়েছিলাম। সময়টা মনে নেই। আমেরিকার স্বীকৃতিও এই টাঙ্গাইলের ওয়াপদা ডাকবাংলোয় বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। এত বড় একটা ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণ হচ্ছে না। সেদিন মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রীকে ব্যাপারটা বলেছিলাম। তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে অগ্রসর হওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু আমি তো দেখছি কোনো কিছুই যথা নিয়মে যথা গতিতে অগ্রসর হয় না, হচ্ছে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বোনকে দেড় বছর আগে কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা জাদুঘরের জন্য এক চিঠি দিয়েছিলাম। চিঠির ৫-৬ দিন পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রীকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছিল। মাননীয় মন্ত্রীর আগ্রহের কোনো অভাব দেখিনি। কিন্তু দফতরে ফাইল চলে না। যেদিন প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় থেকে চিঠি মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে গেছে সেখান থেকে দুই দিনের কাজ হয়েছে বলে আমার মনে হয়নি।

মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি ঢাকা দখলে মিত্রবাহিনীর কোনো পরিকল্পনা ছিল না। ভারতীয় বাহিনীর কাছে পাকিস্তান বাহিনীকে মাটি কামড়ে যুদ্ধ করার মতো একটি বাহিনী হিসেবে প্রতি মুহূর্তে প্রতীয়মান হয়েছে। আর সত্য বলতে কি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগে ভারতীয় বাহিনীর কোথাও কোনো নিরঙ্কুশ বিজয় ছিল না। সেটা ’৪৮-এ জম্মু-কাশ্মীরে, ’৬২-তে চীন সীমান্তে, ’৬৫-তে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে এর কোনোখানেই ভারত দেখাবার মতো তেমন কোনো কৃতিত্ব অর্জন করেনি। তাই একাত্তরে ঢাকা দখল নেওয়া যাবে এমন ধারণা ভারতীয় জেনারেলদের মধ্যে ছিল না। মার্চে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভারতীয় বাহিনী জড়িয়ে পড়তে পারে কি না এরকম একটা আলোচনা ছিল। ভারতের মহীয়সী প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীরও একটা মৌন সম্মতি ছিল। কিন্তু সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব এপ্রিল-মে মাসে অপ্রস্তুত অবস্থায় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে অপারগতা প্রকাশ করেছিল। তারপরও নভেম্বরে যৌথ বাহিনী গঠন করে মিত্রবাহিনী নাম নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে ঢুকতে থাকে। তখন পরিকল্পনা ছিল যদি সম্ভব হয় তাহলে পুবদিকে আখাউড়ার দিক থেকে অগ্রসরমান যৌথবাহিনী ঢাকায় প্রবেশ করবে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে তা হয়নি। উত্তরদিকে গারো পাহাড়ের পাদদেশ থেকে ধেয়ে আসা মিত্রবাহিনী এবং কাদেরিয়া বাহিনী যৌথভাবে ঢাকা দখল নেয়। যেটা কোনো পরিকল্পনাতেই ছিল না। মিত্রবাহিনীর পরিকল্পনা ছিল পশ্চিম-উত্তরে নবীনগর, উত্তর-পূর্বে টঙ্গী এতটা এগিয়ে ঢাকাকে গলা টিপে ধরতে পারলেই উত্তরদিক থেকে এগিয়ে আসা বাহিনীর টাস্ক শেষ। অন্যদিকে বিদেশি নাগরিকদের ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার জন্য ১৬ ডিসেম্বর সকাল ১০টা পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছিল। ঢাকার দিকে ভারী কামান ও আকাশে বিমানে বোমা ফেলার জন্য তৈরি হয়েছিল। আমরা তো নিরন্তর যুদ্ধ করেই চলেছিলাম। কিন্তু মিত্রবাহিনীর একটি কলাম কামালপুর থেকে জামালপুরের ব্রহ্মপুত্রের উত্তর পাড়ে এসে পৌঁছে। কামালপুর থেকে ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে আসা মেজর জেনারেল গিল মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে শুরু থেকেই ওতপ্রোত জড়িয়ে ছিলেন। তিনি এক মাইনসের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অকেজো হয়ে যান। বাঁচবার তেমন কোনো আশা ছিল না। তাকে সঙ্গে সঙ্গে হেলিকপ্টারে প্রথম শিলং বা গোহাটি, সেখান থেকে দিল্লি নিয়ে যাওয়া হয়। তার জায়গায় আসেন নাগরা নামে এক মেজর জেনারেল। যিনি চীন সীমান্তে কোনো এক মাউন্টেন ডিভিশনের কমান্ডার ছিলেন। ভদ্রলোককে যুদ্ধক্ষেত্রে মারাত্মক তৎপর দেখেছি। জামালপুরের দিকে একটা আস্ত ব্রিগেড পরিচালনা করছিলেন ব্রিগেডিয়ার ক্লের। সঙ্গে ছিল কয়েক হাজার মুক্তিবাহিনী। অন্যদিকে ময়মনসিংহ হালুয়াঘাটের দিক থেকে একেবারে জোড়াতালি দেওয়া ভাঙা একটি ব্রিগেড গঠন করে কয়েক হাজার মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে নেমে এসেছিলেন ব্রিগেডিয়ার সানসিং বাবাজি। পরিকল্পনা ছিল চীন সীমান্ত থেকে একটি মাউন্টেন ডিভিশন নামিয়ে আনা হবে। কারণ ডিসেম্বরে বিপুল বরফ পড়ে সীমান্তটি একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু সেবার তেমন বরফ পড়েনি। তাই চীন সীমান্তের মাউন্টেন ডিভিশন তুলে আনতে তারা সাহস করেনি। সেজন্য এমন লেজেগোবরে অবস্থা। তারপরও বিনা বাধায় মিত্রবাহিনীর উভয় কলাম যখন টাঙ্গাইলের মধুপুরের কাছাকাছি এসে পড়ে তখন কাদেরিয়া বাহিনীর নির্দিষ্ট করা নিরাপদ স্থানে এক ব্যাটালিয়ন ছত্রী বাহিনী নামানো হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সেটাই ছিল ভারতীয় ছত্রী বাহিনীর একমাত্র অবতরণ। টাঙ্গাইলের সীমা থেকে একদিকে গাজীপুরের মৌচাক, অন্যদিকে নবীনগর এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে মিত্রবাহিনীকে একটা গুলি গোলাও ছুড়তে হয়নি। জাহাঙ্গীরনগর এলাকায় এক ব্যাটালিয়ন পাকিস্তানি হানাদার ছিল। তাদের সঙ্গে মিত্রবাহিনীর ১৫ তারিখ সারারাত লড়াই হয়। অন্যদিকে মৌচাকের পাশে কড্ডা, পাকিস্তানিরা কড্ডা ব্রিজ ভেঙে দিয়ে দক্ষিণ পাশে অবস্থান নেয়। কিন্তু এলাকার জনসাধারণ ছোট ছোট নৌকায় কড্ডা নদী পাড় করে দিলে পাকিস্তান হানাদাররা পিছু হটতে থাকে এবং এ সময় রকেট লাঞ্চারের আঘাতে পাকিস্তানি দুটি ট্যাংক অকেজো করা হয়। জেনারেল নাগরার সঙ্গে সানসিং এবং মৌচাক থেকে ব্রিগেডিয়ার ক্লেরকে নিয়ে হেলিকপ্টারে আমরা হেমায়েতপুরের পাশে এক ছোট্ট ব্রিজের পাশে নেমেছিলাম এবং আমার ব্যবহৃত টয়োটা জিপের বনাটে কাগজ রেখে জেনারেল নাগরা লিখেছিলেন,

“প্রিয় আবদুল্লাহ,

আমরা এসে গেছি। তোমার সব ভেলকি খতম হয়ে গিয়েছে। আমরা তোমাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছি। বুদ্ধিমানের মতো আত্মসমর্পণ কর। না হলে তোমার ধ্বংস অনিবার্য। আমরা কথা দিচ্ছি আত্মসমর্পণ করলে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী তোমাদের সঙ্গে আচরণ করা হবে। তোমাকে বিশেষভাবে লিখছি, আত্মসমর্পণ করলে তোমার জীবনের নিরাপত্তা দেওয়া হবে।

তোমারই

মেজর জেনারেল নাগরা

১৬/১২/৭১ইং

০৮-৩০ মিনিট।”

আমরা চারজন দূত দিয়ে লেখা পাঠিয়ে ছিলাম নিয়াজির গুহায়। সেখান থেকে দূতেরা ফিরে আসার পথে উত্তেজনায় গাড়ির গতি তীব্র থাকায় সাদা পতাকার স্থলে ফ্ল্যাগ পোস্টে আমরা যে সাদা শার্ট ঝুলিয়ে দিয়েছিলাম তা কখন উড়ে গিয়েছিল বুঝতে পারেনি। তাই আমাদের অগ্রবর্তী দল শত্রু মনে করে গুলি চালিয়ে ছিল। ৪ জনের ৩ জন ঘটনাস্থলেই শহীদ হয়। আমিনবাজারের লাল কৃষ্ণচূড়ার সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধার রক্ত একাকার হয়ে যায়। সেখান থেকে আত্মসমর্পণের পর্ব শুরু হয়েছিল। আমিনবাজারের লোহার ব্রিজ অতিক্রম করে আমরা গিয়েছিলাম। রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজে জেনারেল জামশেদের রাজাকার, আলবদর, আলশামস পাকিস্তান মিলিশিয়ার প্রধান ঘাঁটি। রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সে ভবন এখনো থাকলেও আমিনবাজারে যেটা হওয়ার কথা ছিল স্বাধীনতা সেতু সেটা নেই। হেমায়েতপুরে আমরা যেখানে নেমেছিলাম সেটাও নেই। কেন যেন আমরা থাকতেই স্বাধীনতার কোনো স্মৃতিচিহ্ন রক্ষা হলো না বা হচ্ছে না।

এ যাত্রায় আর এগোতে চাচ্ছিলাম না। কিন্তু চারদিকে অগ্নিকান্ড দুর্যোগ দুর্ঘটনা। রেল লাইনচ্যুত কোনো কোনো পন্ডিত বলছেন গরমে রেললাইন বেড়ে গেছে তাই দুর্ঘটনা। হায়রে কপাল, কাকে কী বলি! সেদিনও চট্টগ্রামে এস আলমের চিনির কারখানায় আগুন নেভাতে ৭০ ঘণ্টা লেগেছে। আগুন লেগে এস আলমের হাজার কোটি ক্ষতি হলেও তার এবং আমাদের কিছু যায় আসে না। সাধারণ মানুষ ইন্স্যুরেন্সের ২-৪ লাখের ক্লেইম নিয়ে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ঘুরে। কিন্তু এস আলমের তা ঘুরতে হবে না। হাজার কোটি ক্ষতি হলে ৫ হাজার কোটির হয়তো ইন্স্যুরেন্স আছে। তা এতদিনে মনে হয় পেয়েও গেছে। আমার প্রশ্ন, অত বড় বিপর্যয়ের পর বাজারে চিনির দামের প্রভাব পড়ছে কি না, মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কি না?

অন্যদিকে আরেক চরম বেদনাদায়ক শোক সংবাদ। রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সাদি আত্মহত্যা করে চিরবিদায় নিয়েছে। কী তার কষ্ট ছিল কিছুই জানতাম না, বুঝতাম না। স্বাধীনতার পর পর মোহাম্মদপুরে কতজনের পাশে দাঁড়িয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। বিখ্যাত সাংবাদিক মোহাম্মদ মোদাব্বের আর চিনু মিয়া ছিলেন এসবের প্রতিকৃত। শিবলী-সাদির বাবাকে হানাদাররা হত্যা করেছিল। এক অসহায় পরিবার। দুবেলা খাবার জুটত না। শিবলী-সাদির মা এক অসাধারণ মানুষ। কতবার কতভাবে সাহায্য করেছি। কিন্তু তাকে হতাশ হতে দেখিনি। স্বাধীনতার পর শিবলী-সাদি থ্রি-ফোরের ছাত্র ছিল। তারপর যখন ওরা বড় হয় শান্তিনিকেতনে পড়ে আমরা তখন বর্ধমানে। ওরা কতবার এসেছে, থেকেছে, খেয়েছে, প্রয়োজনীয় সহযোগিতা নিয়েছে তার কোনো হিসাব নেই। শুধু সাদি কেন, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, লিনা তাপসী, শম্পা রেজা, শেরপুরের মিজু, শাহাজাদপুরের চয়ন আরও কতজন আসত। এখন অনেকের নাম খেয়াল নেই। সেই সাদি বিষণ্ণতা নিয়ে জীবন দিয়েছে। বড় বেশি খারাপ লাগছে। সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ জীবন দেন, তিনিই জীবন নেন। জীবনের ওপর আমাদের কোনো অধিকার নেই; শুধু তাকে রক্ষা করা ছাড়া। জানি না আল্লাহ রব্বুল আলামিন সাদিকে আদৌ ক্ষমা করবেন কি না?

লেখক : রাজনীতিক