রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, মস্কোর ক্রোকাস সিটি হলে হামলাকারী ‘সন্ত্রাসীদের’ জন্য ইউক্রেনে কারা অপেক্ষা করছিল, সেই প্রশ্নটি অনিবার্যভাবে সামনে চলে আসছে এবং এর উত্তর জানা জরুরি।
হামলা শেষে ‘সন্ত্রাসীরা’ কেন ইউক্রেনেই যাওয়ার চেষ্টা করল, সেটি নিয়েও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন তিনি।
মস্কো হামলার বিষয়ে অনুষ্ঠিত রুশ সরকারের একটি বৈঠকে মি. পুতিন এসব কথা বলেছেন বলে জানিয়েছে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা তাস।
“এটা স্পষ্ট যে, যারা কিয়েভের শাসকদের সমর্থন করছে, তারা সন্ত্রাসের সহযোগী হতে চায় না এবং সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষকও হতে চায় না। কিন্তু তারপরও অনেক প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে”, বলেন মি. পুতিন।
অবশ্য রুশ প্রেসিডেন্টের এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে কিয়েভ।
তারা বলছে, হামলা ঠেকানোর ব্যর্থতাকে আড়াল করতেই মি. পুতিন ইউক্রেনের উপর দায় চাপানোর চেষ্টা করছেন।
অন্যদিকে, মস্কো হামলার ঘটনায় এখনও অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর অমীমাংসিত রয়ে গেছে।
ইউক্রেনের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধের পক্ষে জনসমর্থন জোগাড় করার কৌশল হিসেবে রাশিয়া নিজেই ঘটনাটি ঘটিয়েছে কি-না, সে বিষয়েও বিশ্লেষকদের অনেকে সন্দেহ পোষণ করছেন।
নিহতের সংখ্যা বাড়লো
মস্কোয় হামলার ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৩৯ জনে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন রাশিয়ার অপরাধ তদন্ত কমিটির প্রধান আলেকজান্ডার ব্যাস্ট্রিকিন। এর আগে মৃতের সংখ্যা ছিল ১৩৩।
হামলায় আহত শতাধিক মানুষ বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে, যাদের কয়েক জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলেও জানানো হয়েছে।
এছাড়া ক্রোকাস সিটি হলে আগুন ধরানোর জন্য হামলাকারীরা পেট্রোল ব্যবহার করেছিল বলেও জানিয়েছেন মি. ব্যাস্ট্রিকিন।
তিনি বলেন, “তারা প্লাস্টিকের বোতলে পেট্রোল নিয়ে এসেছিলো। তারপর সেটি ব্যবহার করেই তারা হলটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়।”
অভিযুক্ত বন্দুকধারীদের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে, হামলার প্রস্তুতির সাথে সম্পর্কিত বেশ কিছু জিনিসপত্র উদ্ধার করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন রাশিয়ার অপরাধ তদন্ত কমিটির প্রধান।
হামলাকারীরা একটি ভাড়াবাড়িতে থাকত, যে বাড়ির মালিককেও গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মি. ব্যাস্ট্রিকিন।
সব মিলিয়ে হামলার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে এখন পর্যন্ত ১১ জনকে আটক করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
‘উগ্র ইসলামপন্থীদের’ কথা স্বীকার
মস্কোতে হামলার ঘটনায় প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন প্রথমবারের মতো স্বীকার করেছেন যে, ‘উগ্র ইসলামপন্থীরাই’ হামলাটি চালিয়েছে।
তা সত্ত্বেও এই হামলার সাথে কোনও না কোনওভাবে ইউক্রেনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে এখনও মনে করছেন তিনি।
“আমরা জানি যে, এই হামলাটি চালিয়েছে উগ্র ইসলামপন্থীরা, যাদের আদর্শের বিরুদ্ধে ইসলামি বিশ্ব নিজেই শত শত বছর ধরে লড়াই চালিয়ে আসছে”, ক্রেমলিনে একটি বৈঠকে মি. পুতিন এটি বলেছেন বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি।
“কিন্তু যে প্রশ্নটি এখন উঠছে, সেটি হল : এই হামলার ফলে কারা লাভবান হয়েছে?”, বলেন মি. পুতিন।
তিনি আরও বলেন, “রাশিয়া ও তার জনগণের বিরুদ্ধে কারা অপরাধ সংঘটিত করেছে, তা আমরা জানি। কিন্তু এটি করার জন্য কারা তাদেরকে নির্দেশ দিয়েছিল, সেটিই আমাদের আগ্রহের বিষয়।”
গত শুক্রবারের ওই হামলার দায় স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠী। হামলাকারীদের ছবিও প্রকাশ করেছে তারা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও জানিয়েছে যে, ওই হামলার সাথে ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠীই জড়িত এবং এটি নিয়ে সন্দেহ করার কোনও কারণ নেই।
কিন্তু রুশ কর্মকর্তারা বলার চেষ্টা করছেন যে নৃশংস এই হামলার পেছনে কোনও না কোনওভাবে ইউক্রেনের হাত রয়েছে।
এর আগে গত শনিবার টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দাবি করেন যে, মস্কো হামলায় জড়িত চার ‘বন্দুকধারীকে’ গ্রেফতার করা হয়েছে, যারা ইউক্রেনে পালানোর চেষ্টা করছিলেন।
তিনি এটাও দাবি করেছিলেন যে, “সীমান্ত অতিক্রম করানোর উদ্দেশ্যে ইউক্রেন অংশে তাদের (হামলাকারীদের) জন্য একটি জায়গা প্রস্তুত রাখা হয়েছিল।”
কিয়েভ অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি শনিবার বলেছেন, হামলা ঠেকানোর ব্যর্থতাকে আড়াল করতেই ইউক্রেনের উপর দায় চাপাচ্ছেন পুতিন।
“এটা সুস্পষ্ট যে, পুতিন অন্য কারও উপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করছেন। এটি তার পুরনো কৌশল”, বলেন তিনি।
মি. জেলেনস্কি আরও বলেন, “এর আগেও আমরা রাশিয়ায় এরকম ভবনধ্বস, গুলি ও বিস্ফোরণের ঘটনা দেখেছি এবং প্রতি বারই সে অন্যের উপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করেছে।”
হামলাকারী কারা?
রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, মস্কোয় হামলাকারী সন্দেহে চার জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
তারা সবাই মধ্য এশিয়ার দেশ তাজিকিস্তানের নাগরিক। এই দেশটি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নেরই অংশ ছিলো।
গত রোববার সন্দেহভাজন হামলাকারীদের আদালতে নেওয়া হয়।
মস্কো আদালতের আনুষ্ঠানিক টেলিগ্রাম চ্যানেলে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ করা হয়েছে।
নামগুলো হচ্ছে: দালেরদজন মিরজোয়েভ, সাইদাক্রামি মুরোদালি রাচাবালিজোদা, শামসিদিন ফারিদুনি এবং মুহাম্মাদসোবির ফায়জভ।
মি. মিরজোয়েভ তার সব দোষ স্বীকার করে নিয়েছেন বলে জানা গেছে।
কিন্তু আদালতে নেওয়ার সময় অভিযুক্তদের সবার চেহারায় নির্যাতনের চিহ্ন দেখা গেছে।
ফলে তারা যদি দোষ স্বীকারও করে থাকে, আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী সেটি খুব একটা গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।
কারণ নির্যাতনের ভয়ে অনেক সময় মানুষ অন্যায় না করেও দোষ স্বীকার করতে পারে।
রুশ কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে মার্চের শুরুতে অভিযুক্তদের একজনকে মস্কোর ক্রোকাস সিটি হলে নজরদারি করতে দেখা গেছে।
তখন মস্কোতে বড় কোনও জনসমাগমস্থলে হামলা হতে পারে বলে রাশিয়াকে সতর্ক করেছিল যুক্তরাষ্ট্র।
যদিও যুক্তরাষ্ট্রের এই সতর্ক বার্তাকে তখন ‘মিথ্যা প্রচারণা’ বলে উড়িয়ে দিয়েছিল ক্রেমলিন।
রুশ কর্মকর্তারা এখন বলছেন যে, হামলাকারীদের মধ্যে অন্তত দু’জন মস্কোতে হামলা চালানোর উদ্দেশ্যে কিছুদিন আগে রাশিয়ায় আসে।
ইসলামিক স্টেট খোরাসান বা ‘আইএসকে’ তাদেরকে পাঠিয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।
রাশিয়া কেন লক্ষ্যবস্তু?
আইএস-কে যে রাশিয়ায় হামলা চালিয়েছে, সেটির পেছনে বেশ কিছু কারণ কাজ করেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, ইসরায়েল, ইহুদি, খ্রিস্টান, শিয়া মুসলিম, তালেবান এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের সমস্ত শাসককে তারা শত্রু হিসেবে গণ্য করে।
মূলত: তারা যাদেরকে “ধর্মত্যাগী” মনে করে, তারাই তাদের শত্রু। আর সেই তালিকায় প্রথমদিকেই রয়েছে রাশিয়া।
রাশিয়ার সাথে ইসলামিক স্টেটের শত্রুতা শুরু হয়েছিলো গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক এবং ২০০০ সালের প্রথম দিকে চেচনিয়া যুদ্ধকে কেন্দ্র করে।
মস্কোর সেনারা তখন চেচনিয়ার রাজধানী গ্রোজনিকে রীতিমত ধ্বংস করে ফেলেছিল।
অতি সম্প্রতি সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সাথেও নিজেকে জড়িয়েছে রাশিয়া। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পক্ষে যুদ্ধ করছে রুশ সেনারা।
রুশ বিমান বাহিনীর সদস্যরা সিরিয়ার বিদ্রোহীদের অবস্থানকে লক্ষ্য করে অগণিত বোমা হামলা চালিয়েছে।
এভাবে ইসলামিক স্টেট গ্রুপ এবং আল-কায়েদার বিপুল সংখ্যক যোদ্ধাকে তারা হত্যা করেছে।
আফগানিস্তানে রাশিয়াকে আইএস-কে তালেবানের মিত্র হিসাবে দেখে। মূলত: এ কারণেই তারা ২০২২ সালে কাবুলে রুশ দূতাবাসে হামলা চালিয়েছিলো।
এছাড়া ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ১০ বছর তৎকালীন সোভিয়েত সৈন্যরা যেভাবে আফগানিস্তানে দখলদারিত্ব চালিয়েছিলো, সেটি নিয়েও আইএস-কে’র মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।
আইএস-কে রাশিয়াকে একটি খ্রিস্টান রাষ্ট্র হিসেবে দেখে। মস্কো হামলার পর পোস্ট করা ভিডিওতে তারা খ্রিস্টানদের হত্যার কথা উল্লেখ করেছে।
তাজিকিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার অন্যান্য দেশের অভিবাসী শ্রমিকরা মাঝে মধ্যেই রাশিয়ার ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিসের (এফএসবি) সদস্যদের হাতে হয়রানির শিকার হয়ে থাকে।
সেই রাশিয়াকে এখন আইএস-কে তাদের হামলার লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বেছে নিয়েছে।
কারণ প্রতিবেশি ইউক্রেনের সাথে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধে থাকায় সহজেই দেশটিতে অস্ত্র পাওয়া যায় এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থাও খুব একটা জোরালো ছিল না।
যে সব প্রশ্নের উত্তর অজানা
বিবিসি’র নিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিনিধি ফ্রাঙ্ক গার্ডনার বলছেন, মস্কো হামলার ঘটনায় এখনও অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
যেমন: কোনো ধরনের তাড়াহুড়ো না করে হামলাকারীরা ক্রোকাস হলের চারপাশে প্রায় এক ঘন্টা কেন ইচ্ছামত ঘোরাফেরা করলো?
বিশেষ করে রাশিয়ার মতো একটি দেশে, যেখানে পুলিশ এবং ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিসের মতো বিশেষ বাহিনী রয়েছে, সেখানে তারা কীভাবে এটি করতে পারল?
হামলার আগে বন্দুকধারীদের আচরণ দেখে মনে হচ্ছিল যেন তারা জানে যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদেরকে কোনও বাধা দেবে না।
তাছাড়া তাদের কাছে যে কেবল সাধারণ বন্দুকই ছিল বিষয়টি তেমন নয়, বরং আধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রও ছিলো।
কীভাবে তারা এটি জোগাড় করলো এবং নিরাপত্তা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে কীভাবে তারা সেগুলো ঘটনাস্থলে নিতে সক্ষম হল?
হামলার পর তাদেরকে দ্রুত গ্রেফতারের বিষয়টিও অনেকের কাছে বেশ অবাক করার মতো ঘটনা বলে মনে হয়েছে।
ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠীর সদস্যরা এ ধরনের হামলা করার সময় সাধারণত শরীরে আত্মঘাতী বোমার ভেস্ট বা বেল্ট পরে যায় এবং আত্মহত্যা করে।
কারণ তারা মনে করে ধরা পড়ার চেয়ে, আত্মহত্যা করাই শ্রেয়।
কিন্তু মস্কোতে হামলাকারীদের ক্ষেত্রে সেটি দেখা যায়নি।
মস্কো হামলার ব্যাপারে বলা হচ্ছে যে, এটি গত দুই দশকের মধ্যে রাশিয়ায় সবচেয়ে বড় হামলা।
রুশ কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায় বসে হামলাকারীদের এই নির্মম হত্যাকাণ্ড চালালো। অথচ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা সেটি ঠেকাতে ব্যর্থ হলো।
আবার দেখা যাচ্ছে, ঘটনার পর সেই একই রুশ কর্তৃপক্ষ হামলাকারীদের গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করতে খুব বেশি সময় নেয়নি।
সব মিলিয়ে ঘটনাটি ক্রেমলিনের তথাকথিত “অভ্যন্তরীণ কাজ” বা ইউক্রেনের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধের পক্ষে জনসমর্থন জোগাড় করার একটি “সাজানো অভিযান” কি না, সে বিষয়ে বিশ্লেষকদের অনেকেই সন্দেহ পোষণ করছেন।
তবে তাদের এই সন্দেহের পক্ষে শক্ত কোনো তথ্যপ্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি।
তা ছাড়া মার্কিন গোয়েন্দারাও নিশ্চিত করেছে যে, ইসলামিক স্টেটই মস্কোয় হামলা চালিয়েছে।