ইসরায়েলে গভীর রাজনৈতিক বিভাজন আবারো প্রকাশ্যে রুপ নিয়েছে। গত ৭ই অক্টোবর হামাসের সাথে যুদ্ধ শুরুর পর এই বিরোধ কিছু সময়ের জন্য বন্ধ থাকলেও এখন ইসরায়েলের রাস্তায় হাজার হাজার বিক্ষোভকারী নেমে এসেছে।

ইসরায়েলের দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে ক্ষমতাচ্যুত করতে বিক্ষোভকারীরা এক ধরনের অনড় অবস্থান নিয়েছে।

জেরুজালেমের রাস্তায় বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দিতে পুলিশকে জল কামান থেকে গুলি ও স্প্রে করতে দেখা গেছে।

এ সময় বিক্ষোভকারীরা সরকার বিরোধী বিভিন্ন ধরনের শ্লোগান দিচ্ছিলো। গাজায় বন্দি ১৩৪ জন ফিলিস্তিনিকে মুক্ত করতে চুক্তির করার জন্যও তারা আহবান জানান। যদিও তাদের মধ্যে অজ্ঞাত সংখ্যক এরই মধ্যে মারা গেছে।

তাদের বন্ধু ও পরিবারগুলোর আশঙ্কা হচ্ছে, চুক্তি ছাড়া এই যুদ্ধ যত দীর্ঘ হবে বন্দিরা তত বেশি মারা যাবে।

রবিবার সন্ধ্যায় ইসরায়েলি পার্লামেন্টের চারপাশে হাজার হাজার মানুষকে বিক্ষোভ করতে দেখা যায়। যার মধ্যে একজন ছিলো কাতিয়া অ্যামোরজা। যার ছেলে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে কর্মরত আছেন, এখন যে গাজায় দায়িত্ব পালন করছেন। এই বিক্ষোভের সময় তিনি হ্যান্ড মাই রাখলেন এই বলে,

‘আজ সকাল আটটার পর থেকে আমি এখানে রয়েছি। আমি নেতানিয়াহুকে বলতে চাই, দেশ ছাড়ার জন্য আমি তোমাকে একটি প্রথম শ্রেণির টিকেট দিতে পারলে খুশি হবো। তুমি চলে যাও, আর এদেশে ফিরো না”।

বিক্ষোভকারী কাতিয়া নেসেট ভবনের বাইরে নেতানিয়াহুকে পদত্যাগ করার আহবান জানান
ছবির ক্যাপশান,বিক্ষোভকারী কাতিয়া নেসেট ভবনের বাইরে নেতানিয়াহুকে পদত্যাগ করার আহবান জানান

“এবং আমি তাকে এটিও বলছি যে, সেই সমস্ত লোকদের সাথে নিয়ে যান, যাদেরকে আপনি সরকারে বসিয়েছেন। তারা আমাদের সমাজের সবচেয়ে খারাপ মানুষ”।

কাটিয়া যখন মাইকে কথাগুলো বলছিলেন, তখন তার পাশ থেকে ইয়েহুদাহ গ্লিক নামের একজন ইসরায়েলি ধর্মযাজক যাচ্ছিলেন। যিনি ইসরায়েলি টেম্পল মাউন্টে ধর্ম প্রচার করে থাকেন। জেরুজালেমের এই টেম্পল মাউন্টকে মুসলমানদের কাছে পরিচিত আল আকসা নামে। যেটি ইসলাম ধর্মের তৃতীয় পবিত্র স্থান।

ধর্মযাজক তখন বলেন, “আমি মনে করি নেতানিয়াহু খুব জনপ্রিয়। এটিই মনে হয় বিক্ষোভকারীদের সবচেয়ে বড় ভয়। আমি মনে করি এই বিক্ষোভকারীরা এতদিন তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে আসছে, হয়তো নেতানিয়াহু এতদিন ধরে ক্ষমতায় আছে এই সত্য তারা মানতে চান না”।

বিক্ষোভকারীরা এবং অন্য দেশের যারা মি. নেতানিয়াহুর সমালোচক তারা মনে করেন, গণতন্ত্রের শত্রুরা নেতানিয়াহুর সরকারেই আছে। এর মধ্যে অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিকের ধর্মীয় জায়োনিজম পার্টিও রয়েছে। তাদের দলের একজন সংসদ সদস্য ওহাদ তাল বলেন, “হামাসের উপর সামরিক চাপ ছাড়া তারা কখনো বন্দিদের মুক্তি দিবে না”।

বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দিতে রাস্তায় পুলিশের তৎপরতা
ছবির ক্যাপশান,বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দিতে রাস্তায় পুলিশের তৎপরতা

“আপনি মনে করেন না যে হামাস একটি চুক্তিতে এত সহজে জিম্মিদের ফিরিয়ে দিবে, সবাইকে মুক্তি দিবে এটা এত সহজ নয়”।

তিনি বলছিলেন, “আপনার হাতে যদি একটি বোতাম থাকতো এবং এটি আপনি টিপ দিলেই সব জিম্মিকে ফিরিয়ে আনা যেতো তাহলে ইসরায়েল সেই বোতামই টিপতো। জিম্মিদের ফিরিয়ে আনা যত সহজ ভাবা হচ্ছে তত সহজ নয়”।

অনেক ইসরায়েলি বিশ্বাস করেন, বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুই একমাত্র ব্যক্তি যে তার দেশকে নিরাপদ রাখতে পারেন।

তিনি বলেছিলেন যে, নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনিদের পরিচালনা করতে পারেন, একটি রাষ্ট্রের জন্য ইহুদিদের দখলকৃত জমিতে বসতি স্থাপন করতে পারেন এবং ছাড় না দিয়ে এবং শান্তি চুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় ত্যাগও স্বীকার না করে। গত বছরের ৭ অক্টোবরের সীমান্ত থেকে হামাস আক্রমণ করে তখন সব কিছু পরিবর্তন হয়ে যায়।

তার নিরাপত্তা প্রধান এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেন যে, বিক্ষোভকারীরা ভুল করেছে, মি. নেতানিয়াহু কখনোই কোনো দায় এড়াননি। এই বিজ্ঞপ্তিটি তখন জারি করা হয় যখন, জেরুজালেমের রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ প্রদর্শন করছিলো।

ইসরায়েলিদের অবশ্যই ৪০ বছর আগের কথা মনে করতে হবে, যখন ইসরায়েলি রাজনীতিতে নেতানিয়াহু প্রভাবশালী কেউ ছিলেন না।

জাতিসংঘে ইসরায়েলের একজন বাকপটু মুখপাত্র হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার মেয়াদ শুরু হয় ১৯৯৬ সালে অসলো শান্তি প্রক্রিয়ার বিরোধিতাকারী প্ল্যাটফর্মে একটি ছোট বিজয়ের মধ্য দিয়ে।

বিক্ষোভকারীরা ইসরায়েলের রাস্তায়
ছবির ক্যাপশান,বিক্ষোভকারীরা ইসরায়েলের রাস্তায়

অসলো চুক্তি এই ধারণা তৈরি করেছিলো যে ইসরায়েলের পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অনুমতি প্রদান করা হবে। ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আরব এবং ইহুদিদের মধ্যে দীর্ঘ বিরোধ নিরসনের একমাত্র আশা ছিলো এই চুক্তি।

ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বরাবরই বিরোধী ছিলেন মি. নেতানিয়াহু। তিনি মধ্যপ্রাচ্যের পুনর্নির্মাণের জন্য একটি “বড় দর কষাকষির” অংশ হিসাবে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকে সমর্থনের জন্য মার্কিন কৌশলকে অবজ্ঞার সাথে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

এখন তার সমালোচকরা বলেছেন যে, যুদ্ধের পরে গাজায় শাসনের জন্য রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের পরিকল্পনার কঠোর প্রত্যাখ্যান ইসরায়েলের চরম ডানপন্থীদের অব্যাহত সমর্থন নিশ্চিত করার একটি হাতিয়ার।

নেসেটের বাইরে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে একজন ছিলেন ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডেভিড অ্যাগমন। নেতানিয়াহু যখন প্রথম নির্বাচিত হন তখন তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক ছিলেন।

“এটি ১৯৪৮ সালের পরে একটি বড় সংকট। আমি ১৯৯৬ সালে যখন নেতানিয়াহুর প্রথম চিফ অফ স্টাফ ছিলাম, তখন থেকেই আমি তাকে চিনি। সেখানে তিন মাস পরে আমি চাকরি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কারণ আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে এই নেতা ইসরায়েলের জন্য বিপদ”।

বিক্ষোভকারীরা যখন রাস্তায় তখনও, মি. নেতানিয়াহু আগাম নির্বাচনের এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। একই সময় তিনি রাফায় হামাসের বিরুদ্ধে নতুন করে হামলা চালানোর পরিকল্পনায় ব্যস্ত ছিলেন।

হামাসকে ধ্বংস করার ব্যাপারে ইসরায়েলিরা বিভক্ত নয়। সেই যুদ্ধের লক্ষ্যে তাদের সমর্থনও রয়েছে। তবে, যেভাবে যুদ্ধ পরিচালনা হচ্ছে এবং জিম্মিদের মুক্ত করতে ব্যর্থতা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে বেশ চাপে ফেলেছে।