বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বা বিএনএম নামে রাজনৈতিক দল গঠন এবং তাতে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের কথিত যোগদানের বিষয়ে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব:) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ।
মঙ্গলবার ঢাকার বনানীতে নিজের বাসায় এ বিষয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, “নির্বাচনের আগে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানকে আমার কাছে নিয়ে আসা হয়েছিল। সাকিব নিজেই রাজনীতিতে যোগ দেয়ার ইচ্ছা জানায়। তবে নতুন দলে যোগ দিতে সাকিবকে উৎসাহ দিইনি আমি।”
একই সাথে সে সময় নতুন দল গঠন করতে ক্ষমতাসীন দলের তরফে তার কাছে প্রস্তাব থাকলেও তা গ্রহণ করেননি বলে দাবি করেন মেজর হাফিজ।
এদিকে, একই দিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাকিবের বিএনএমে যোগদানের বিষয়ে আগে কিছু জানতেন না বলে দাবি করেছেন।
দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “বিষয়টি মিডিয়ায় দেখেছি। এ সম্পর্কে কিছু জানা ছিল না। আগের বিষয়টা জানি না।”
“সাকিব এখন আওয়ামী লীগের টিকেটে মাগুরা-১ থেকে নির্বাচন করেছেন, জয়লাভও করেছেন। নমিনেশন নেওয়ার সময় দলের প্রাথমিক সদস্য হয় সাকিব। এর আগে সাকিব দলের কেউ ছিলেন না। নমিনেশন দেয়ার সময় প্রাথমিক সদস্য পদ দিতে হয়”, জানান ওবায়দুল কাদের।
সম্প্রতি একটি গণমাধ্যমে নির্বাচনের আগে সাকিব আল হাসানের সাথে মেজর হাফিজের একটি ছবি-সহ সংবাদ প্রকাশ করা হয়।
যাতে বলা হয়েছে, বিএনএম গঠনের নেপথ্য কারিগর হিসেবে কাজ করেছেন মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমেদ। সে দলে সাকিব আল হাসান যোগ দিয়েছিলেন।
বিএনপির ওই নেতার বাসভবনে বিএনএমের সদস্য ফরম পূরণ করে সাকিবের যোগ দেয়ার ‘প্রস্তুতিপর্বে’র ছবি প্রকাশ করেছে ওই গণমাধ্যম।
নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ওই ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করা হয়েছে।
তবে পরবর্তী সময়ে নতুন দলে না গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে যোগদান করেন সাকিব আল হাসান।
এখন এই ছবি-সহ সংবাদটি প্রকাশের পরই তা নিয়ে চলছে তুমুল জল্পনা।
যা জানালেন মেজর হাফিজ
‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিত বিএনএমে যোগ দেওয়া ও সাকিব আল হাসানের সাথে ছবি প্রকাশের বিষয়ে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করতে মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন করেন মেজর হাফিজ।
নির্বাচনের পাঁচ-ছয় মাস আগে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানকে কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা তার কাছে নিয়ে যান বলে ওই সংবাদ সম্মেলনে জানান তিনি।
তিনি বলেন, “সাকিব আল হাসানকে আমার কাছে নিয়ে আসে, সে এসে রাজনীতিতে যোগদানের ইচ্ছা ব্যক্ত করে। বিএনএমের দুজন কর্মকর্তা তাকে আমার কাছে নিয়ে আসেন।”
“আমি বলেছি, রাজনীতি করা তোমার বিষয়। তুমি এখনও খেলাধুলা করছো। রাজনীতি করবে কি না, সেটা তোমার বিষয়। আমার কাছ থেকে উৎসাহ না পেয়ে সে চলে যায়”, জানান মেজর হাফিজ।
বিএনপির এই নেতা বলেন, “সাকিব কোনও দিন রাজনীতি করে নাই। করতেই পারে। আমি যোগদান না করায় তিনিও তার পথ বেছে নিয়েছেন।”
“যেখান থেকে সহজে জেতা যাবে, যে নির্বাচনে কোনও প্রতিপক্ষ থাকবে না … সম্পূর্ণ পাতানো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এমপি হয়েছেন সাকিব, এটি তার বিষয়। এটি তার অধিকার রয়েছে, যে কোনও দলে সে যোগ দিতেই পারে”, মন্তব্য করেন মেজর হাফিজ।
জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে নেওয়ার জন্যই নির্বাচনের এতদিন পর এই ছবি প্রকাশ করে সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তার কথায়, “এমন কিছু করিনি যার জন্য লজ্জিত হতে হবে।”
মি. হাফিজ বলেন, “কী করেছি, কী অপরাধ করেছি আমি? আমি কি বিএনএমে যোগ দিয়েছি? দল ভেঙেছি?”
“আমি তো দেশেই ছিলাম না। দুই মাস আগে আমার উদ্দেশ্য ও আমার পরিকল্পনা জনসম্মুখে প্রকাশ করে গেছি!”
নতুন দল গঠনে চাপ ছিল?
মঙ্গলবার বনানীতে নিজ বাসায় ওই সংবাদ সম্মেলনে মেজর হাফিজআরও দাবি করেন, নির্বাচনের ছয় মাস আগে সরকারি দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা তার সাথে যোগাযোগ করতে শুরু করেন।
“তখনকার তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ঘোষণাই দিয়ে দিলেন হাফিজ সাহেব নতুন দল গঠন করবেন। নির্বাচনে যাবেন।”
“পর দিনই সংবাদ সম্মেলন করে বলি ৩২ বছর ধরে বিএনপিতে আছি। এই দলেই থাকব। তারা অ্যাপ্রোচ করেছেন প্রস্তাব গ্রহণ করি নাই। এটা তো গোপন কিছু না”, জানান তিনি।
মেজর হাফিজ বলেন, “এখন অপপ্রচার চালিয়ে বিভ্রান্তি তৈরির চেষ্টা চলছে”।
“দেশে গণতন্ত্র নেই। রাজনীতি অত্যন্ত নোংরা। নির্বাচনের সময় নানা কলাকৌশল হয়। যে দলই ক্ষমতায় থাকে, তারা চেষ্টা করে প্রতিপক্ষকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য। কিছু লোক ভাগিয়ে এনে নিজেদের দলে বা অন্য কোনও দলে দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চায়”, বলেন তিনি।
তিনি বলেন, “তারা দেখেছে বিএনপির নীতিনির্ধারণী বিষয়ে মাঝে মধ্যেই আমার দ্বিমত থাকে। সেখান থেকে তারা ধরে নিয়েছিল আমি বিএনপি ত্যাগ করতে চাই।”
সে সময় সরকারি দলের চাপ বাড়তে থাকার এক পর্যায়ে সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপি ছাড়ার সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছিলেন মি. হাফিজ।
মঙ্গলবার তিনি জানান, “ওই সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলাম বিএনএম বা অন্য কোনও দলে আমার যোগদানের কোনও সম্ভাবনা নেই।”
শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকার কথা উল্লেখ করে সে সময় মেজর হাফিজ রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার কথাও বলেছিলেন বলে মঙ্গলবার জানান।
নির্বাচনের পাঁচ-ছয় মাস আগে সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত পরিচিত কয়েকজন কর্মকর্তাও তাকে নতুন দল গঠন করার পরামর্শ দিয়েছিলেন বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান বিএনপির এই ভাইস চেয়ারম্যান।
মেজর হাফিজ বলেন, “তাদের বলেছিলাম রাজনীতিতে কোন শর্টকাট নেই। সাধারণ মানুষের সংস্রব ছাড়া রাজনীতিতে টিঁকে থাকা যায় না।”
বিএনপি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও সে সময় সাবেক মন্ত্রী মেজর হাফিজের বিএনএমে যোগ দেওয়ার বিষয়ে গুঞ্জন উঠেছিল।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর-সহ শীর্ষস্থানীয় নেতারা সে সময় তার কাছে প্রকৃত বিষয় জানতে চাইলে তাদেরকেও বিষয়টি স্পষ্ট করেছিলেন বলে জানান মি. হাফিজ।
“এগুলো সরকারি প্রোপাগান্ডা। আমি বিএনপি ছেড়ে কোথাও যাব না। এই বয়সে তো আমার কোন রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ নেই।”
“দুইবার মন্ত্রী হয়েছি, আর কত? ৬বার এমপি হয়েছি জনগণের ভোটে, গুড এনাফ। আমার তো নতুন দলে যোগদানের দরকার নাই, কিংস পার্টি খোঁজার দরকার নাই”, বলেন তিনি।
সাকিব প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের
রাজধানীর গুলিস্তানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মঙ্গলবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের রাজনীতিতে যোগদানের বিষয়ে কথা বলেন।
ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের বিএনএমে যোগদানের বিষয়ে তার কিছু জানা ছিল না বলে দাবি করেন ওবায়দুল কাদের।
তিনি বলেন, “বিষয়টি আমি মিডিয়াতে দেখেছি। এ সম্পর্কে আমার কিছু জানা ছিল না।”
“সাকিব এখন আওয়ামী লীগের টিকিটে মাগুরা-১ থেকে নির্বাচন করেছেন, জয়লাভও করেছেন। নমিনেশন দেওয়ার সময় দলের প্রাথমিক সদস্য পদ নিতে হয়। তবে এর আগের বিষয়টা আমি জানি না”, বলেন ওবায়দুল কাদের।
বিএনপিকে আওয়ামী লীগের ভাঙতে চাওয়ার অভিযোগও অস্বীকার করেন মি. কাদের।
তিনি বলেন, “বিএনপিকে আমরা ভাঙতে যাবো কেন? আমাদের কি কোনও দুর্বলতা আছে যে বিএনপি থেকে লোক এনে সে ঘাটতি আমাদের পূরণ করতে হবে?”
আওয়ামী লীগের বহু লোক রয়েছে জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, “আওয়ামী লীগের প্রার্থিতা গত নির্বাচনের সময় আপনারা দেখেছেন … কত ভিড়। আওয়ামী লীগে কোন দুর্বৃত্ত নেই।”
দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে অন্যতম ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া বিএনএম সৃষ্টি নিয়ে সরকারের কোনও ভূমিকা ছিল কি না, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের কাছে এমন প্রশ্ন করেন সাংবাদিকরা।
উত্তরে ওবায়দুল কাদের বলেন, “সরকারি দল কিংস পার্টি করতে যাবে কেন? কোনটা কিংস পার্টি কোনটা প্রজা পার্টি এ সম্পর্কে আমাদের কিছু জানা নেই।”
“নির্বাচনের আগে শত ফুল ফোটে। এটা আরেকটা ফুল ফুটেছে। তারা নির্বাচন করবে। নিবন্ধন করেছে। সেটা নির্বাচন কমিশনকে জিজ্ঞেস করেন, তারা কাকে নিবন্ধন দিয়েছে। এখানে আওয়ামী লীগের কোন চাপ ছিল না” মন্তব্য করেন মি. কাদের।
বিএনপির নেতারা ক্লান্ত, কর্মীরা হতাশ বলে মন্তব্য করে মি. কাদের তাদের আওয়ামী লীগের নামে এসব ‘অপপ্রচার, মিথ্যাচার’ বন্ধ করারও আহ্বান জানান।
বিএনএমে যোগদান ও যে ছবি প্রকাশ হয়েছে সে বিষয়ে কথা বলতে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের সাথে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করা হলেও ফোন ধরেননি তিনি।