বাংলাদেশে প্রতি বছরই ঈদের আগে বকেয়া বেতন-বোনাসের দাবিতে পোশাক খাতে কমবেশি অস্থিরতা দেখা দেয়। বহু শ্রমিক রাস্তা অবরোধ করে আন্দোলন করেন, এ সময় চরম ভোগান্তিতেও পড়ে জনগণ।

জনগণের এমন ‘ভোগান্তি লাঘবে’ সম্প্রতি বাংলাদেশের ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ যেসব পোশাক কারখানা বেতন বোনাস দিতে পারবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে তাদের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে।

তারা বলছে, পোশাক শিল্প মালিকরা ঈদের আগেই যাতে বেতন বোনাস পরিশোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে সেজন্য আগাম সতর্কতার অংশ হিসেবেই তা করা হয়েছে।

প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, পোশাক শিল্প মালিকরা বেতন পরিশোধ করতে না পারলে সরকার কি ব্যবস্থা নিতে পারে?

আর ব্যবসায়ীরাই বা এই ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে কি পদক্ষেপ নিচ্ছেন?

পোশাক শিল্প মালিকরা বলছেন, যে কোন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে ইতোমধ্যেই তারা কারখানাগুলোর সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানে উদ্যোগ নিয়েছেন।

এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংককে তাদের পাওনা প্রণোদনা ছাড়ের অনুরোধও করা হয়েছে।

ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, কোনও কারখানা বেতন দিতে ব্যর্থ হলে মধ্যস্থতার উদ্যোগ নেয় সরকার। এমন কী প্রয়োজন সাপেক্ষে সরকারের নির্ধারিত তহবিল থেকেও সহায়তা দেওয়া হয়।

কারখানা
ছবির ক্যাপশান,ঈদুল ফিতরের আগে বেতন -বোনাস দিতে সরকার আহ্বান জানিয়েছে

ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের তালিকায় যা রয়েছে

আসন্ন ঈদুল ফিতরের আগে যেসব শিল্প-কারখানাগুলো বেতন ও বোনাস পরিশোধে সমস্যায় পড়তে পারে এমন সব প্রতিষ্ঠানের তালিকা করেছে বাংলাদেশের ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ।

এ তালিকা অনুযায়ী, সমস্যায় পড়তে পারে এমন শিল্প কারখানার সংখ্যা ৪১৬টি।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের এক হাজার ৫৮৯টি কারখানার মধ্যে এই তালিকায় রয়েছে ১৭১টি।

এদের মধ্যে বেতন দিতে ব্যর্থ হতে পারে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫৬টি, বোনাস দিতে ব্যর্থ হতে পারে ৪১টি।

বেতন ও বোনাস উভয়ই দিতে ব্যর্থ হতে পারে এমন প্রতিষ্ঠান ৭৪ টি।

এ তালিকায় দেখা যায়, বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সদস্য ৭১টি।

এদের মধ্যে বেতন দিতে ব্যর্থ হতে পারে ২১টি কারখানা, বোনাস দিতে ব্যর্থ হতে পারে ২৮টি কারখানা।

বেতন ও বোনাস দুইটিই দিতে ব্যর্থ হতে পারে এমন কারখানার সংখ্যা ২২টি।

তালিকাটিতে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) ২৯টি কারখানা বেতন বোনাস পরিশোধে ব্যর্থ হতে পারে।

এদের মধ্যে শুধু বেতন দিতে ব্যর্থ হতে পারে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১৩টি। বোনাস দিতে ব্যর্থ হতে পারে চারটি প্রতিষ্ঠান।

বিটিএমএ’র প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বেতন ও বোনাস উভয়ই দিতে ব্যর্থ হতে পারে ১২টি।

ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের এই তালিকায় বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ বা বেপজার ৩৮৩টি কারখানার মধ্যে ১৩টি কারখানা রয়েছে।

এগুলোর মধ্যে তিনটি কারখানা বেতন দিতে ব্যর্থ হতে পারে। বোনাস দিতে ব্যর্থ হতে পারে সাতটি।

বেতন ও বোনাস দুইই দিতে ব্যর্থ হতে পারে আরো তিনটি কারখানা।

এছাড়াও অন্যান্য ৬৫১টি কারখানার মধ্যে সমস্যা হতে পারে ১৩২টি কারখানাতে।

এর মধ্যে বেতন দিতে ব্যর্থ হতে পারে ৩৮টি, বোনাস দিতে ব্যর্থ হতে পারে ২৮টি কারখানা।

বেতন ও বোনাস দুইটিই দিতে ব্যর্থ হতে পারে ৬৬টি কারখানা।

কারখানা
ছবির ক্যাপশান,বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য তৈরি পোশাক খাত গুরুত্বপূর্ণ।

ঝুঁকিতে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো যা বলছে

ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের করা ঝুঁকির তালিকায় গার্মেন্টস সেক্টরের বেশ বড় বড় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও রয়েছে। এমন একটি প্রতিষ্ঠান ক্লাসিক ফ্যাশন কনসেপ্ট লিমিটেড।

এটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শহীদুল্লাহ আজিম। যিনি বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট।

শহীদুল্লাহ আজিম জানান, চলমান বৈশ্বিক বাণিজ্য পরিস্থিতি, মূল্যস্ফীতি, ক্রয়াদেশ কম থাকা-সহ নানা কারণে পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো চরম সংকটে রয়েছে।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “শ্রমিকদের বেতন বেড়ে গেছে, ইউটিলিটি কস্ট বেড়ে গেছে। অন্যদিকে ক্রয়াদেশ কমে গেছে। ফলে অনেক ফ্যাক্টরিই চাপে আছে। ”

“বেশির ভাগ ফ্যাক্টরিই স্ট্রাগল করছে। প্রতি বছরই এই রিপোর্ট হয়। দাম কম, মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়াতে অর্ডার কম ছিলো। তাই সবাই কোণঠাসা অবস্থায় আছে”, যোগ করেন তিনি।

মি. আজিম বলেন, “সবাই চেষ্টা করছে যাতে ঈদের আগে বেতন ভাতা পরিশোধ করা যায়।”

তার নিজ প্রতিষ্ঠানে ও ঈদের আগে বেতন-বোনাস দিতে সমস্যা হবে না বলে জানান মি. আজিম।

ঈদের আগে বেতন-বোনাসকে কেন্দ্র করে যাতে কোনও অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি তৈরি না হয় সে বিষয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান গার্মেন্টস সেক্টরের নেতারা।

বিজিএমইএ-র সভাপতি ফারুক হাসান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ইতোমধ্যেই সব ফ্যাক্টরিগুলোতে কার কী সমস্যা তা জানাতে একটি ফরম্যাট পাঠানো হয়েছে। যাতে সমস্যা সমাধান করা যায়।”

“ব্যাংকগুলো যাতে তাদের সাপোর্ট ও সুবিধা দেয় সেজন্য অনুরোধ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে প্রণোদনা বাবদ প্রায় পাঁচ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। সাধারণত ঈদের আগে তারা এগুলো রিলিজ করে”, জানান মি. হাসান।

তিনি বলেন, “এই সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রণোদনা ছাড় করে দেবে। কয়েকদিন আমরা প্রত্যেকটি ফ্যাক্টরি রেগুলার মনিটর করবো যাতে ঈদের আগে সবাই বেতন-বোনাস দিতে পারে।”

পোশাক
ছবির ক্যাপশান,ঈদের আগে বেতন দিতে পারবে না এমন কারখানার তালিকা করেছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ

সমাধান কীভাবে হয়?

গার্মেন্টস সেক্টরের ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, সাধারণত ঈদের আগেই এ ধরণের সমস্যা হয়। এক্ষেত্রে নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করে এসব সমস্যা সমাধানে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়।

বিজিএমইএ-র সভাপতি ফারুক হাসান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “শেষ মুহূর্তে সমঝোতার মাধ্যমে পদক্ষেপ নেওয়া হয় যাতে সমস্যা সমাধান করা যায়। ট্রেড ইউনিয়ন নেতা, শ্রমিক নেতাদের সাথে আলোচনায় বসে ব্যাংক থেকে লোন করার ব্যবস্থাও করি।”

“আবার বিজিএমইএ থেকেও সাপোর্ট দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। আবার বায়ারের পেমেন্ট বা কোনও পার্টির কাছে বকেয়া টাকা রয়েছে কি না, সব বিষয় আমলে নিয়েই সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়”, বলেন মি. হাসান।

সাধারণত এ ধরনের যে কোনও প্রতিষ্ঠানে বেতন-বোনাস পরিশোধের বিষয়টি ওই প্রতিষ্ঠানেরই ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব।

আর এসব বিষয় লঙ্ঘন হচ্ছে কি না তা তদারকি করে শ্রম মন্ত্রণালয় ও কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর।

এক্ষেত্রে কারখানা বন্ধ করা-সহ যে কোনও ব্যবস্থা নিতে পারে শ্রম মন্ত্রণালয়।

তবে, ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, কারখানা বন্ধ করে দেওয়া কোন সমাধান না। কারণ কারখানা বন্ধ করে দিলে শ্রমিকরা আর বেতন পাবে না। ফলে এটা সমঝোতা করে এমনভাবে কাজ করানোই সমীচিন, যাতে সমস্যার সমাধান করা যায়।

অনেক সময় কারখানার মেশিন বিক্রি করেও শ্রমিকদের বকেয়া বেতন – বোনাসের ব্যবস্থা করা হয়।

মি. ফারুক হাসান বলেন, “ব্যাংক থেকে লোন করে বিজিএমইএ থেকে কিছু সাপোর্ট দিয়ে কারখানাগুলো যাতে শ্রমিকদের বেতন দিতে পারে সে ব্যবস্থা করা হয়।”

এছাড়া এ ধরনের প্রেক্ষাপটে সরকার বিজিএমইএ ও কারখানাগুলোর মধ্যে মধ্যস্থতার উদ্যোগ নেয়। যাতে করে সমস্যা চিহ্নিত করে সুরাহা করা যায়।

মোহাম্মদী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবানা হক বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সব সময়ই সরকার এ ধরনের পরিস্থিতিতে মধ্যস্থতা করেন। এমন না যে করেন না। সরকারের একটি তহবিলও রয়েছে।”

“যে সব প্রতিষ্ঠান একেবারেই বেতন বোনাস দিতে ব্যর্থ হতে পারে, ফ্যাক্টরির অবস্থা খুবই খারাপ, তাদের ওই তহবিল থেকে সরকার অর্থ সহায়তা দিয়ে থাকে”, জানান মিজ হক।

এ বিষয়ে কথা বলতে শ্রম মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মাহবুব হোসেনের মোবাইলে ফোন করলেও রিসিভ করেননি তিনি।