সিরিয়ায় ইরানি দূতাবাসে ইসরায়েলি হামলার পর হরমুজ প্রণালিতে ইসরায়েল সংশ্লিষ্ট একটি জাহাজ জব্দ করেছে ইরান। ইরানের ইসলামিক বিপ্লবী বাহিনী (আইআরজিসি) জাহাজটি জব্দ করে নিজেদের জলসীমায় নিয়ে গেছে বলে জানিয়েছে ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম। জাহাজ জব্দের পর ইসরায়েলি ভূখ- লক্ষ্য করে শত শত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। তেহরান জানিয়েছে, সিরিয়ায় হামলার জবাব দেওয়া শেষ করেছে তারা। তবে ইসরায়েল পাল্টা পদক্ষেপ নিলে তেহরানও চুপ করে থাকবে না। হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে তারা। এদিকে, ইসরায়েলে ইরানি হামলার প্রভাবে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বাজারে মন্দাভাব শুরু হয়েছে।

গত শনিবার ইরানি রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম জানায়, সিরিয়ায় ইরানি দূতাবাসে ইসরায়েলি হামলায় দুই জেনারেলসহ সাত সদস্য নিহতের প্রতিশোধ হিসেবে ইরানের ইসলামিক বিপ্লবী বাহিনী (আইআরজিসি) হরমুজ প্রণালির কাছ থেকে পর্তুগিজ পতাকাবাহী এমএসসি অ্যারাইস নামের একটি জাহাজ জব্দ করে। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে জাহাজটি ভারতের উদ্দেশে রওনা হয়েছিল। জাহাজটি লন্ডনভিত্তিক জোডিয়াক ম্যারিটাইমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এটি জোডিয়াক গ্রুপের একটি অংশ যা পরিচালনা করে ইসরায়েলি ধনকুবের আইয়াল অফার ও তার পরিবার।

সিরিয়ার হামলার পর হরমুজ প্রণালির কাছে জাহাজ জব্দ করে শনিবার রাতের শেষ প্রহরে প্রথমবারের মতো ইসরায়েলি ভূখ- লক্ষ্য করে শত শত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ইরান। ইরানের এই হামলার পর আবারও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে হরমুজ প্রণালি নিয়ে উত্তেজনা।

মধ্যপ্রাচ্য থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় তেল রপ্তানি করা হয় হরমুজ প্রণালির মাধ্যমে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল যায় এশিয়া, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং অন্যান্য স্থানে। হরমুজ প্রণালির একদিকে আছে আরব দেশগুলো, অন্য পাশে আছে ইরান।

হরমুজ প্রণালির সবচেয়ে সংকীর্ণ অংশটি থেকে ইরান এবং ওমানের দূরত্ব মাত্র ২১ মাইল। এই প্রণালিতে জাহাজ চলাচলের জন্য দুটো লেন আছে এবং প্রত্যেক লেন দুই মাইল প্রশস্ত। সংকীর্ণ হলেও জ্বালানি তেল বহনের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জাহাজ চলাচল করার জন্য হরমুজ প্রণালি যথেষ্ট গভীর এবং চওড়া।

পৃথিবীতে যে পরিমাণ জ্বালানি তেল রপ্তানি হয়, তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ হরমুজ প্রণালি দিয়ে যায়। হরমুজ প্রণালি হচ্ছে ইরানের জ্বালানি তেল রপ্তানির প্রধান রুট। ইরানের অর্থনীতির জন্য এটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।

হরমুজ প্রণালির স্পর্শকাতরতা সামনে আসে ১৯৮০ দশকে ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময়। ওই সময় ইরাক ও ইরান পরস্পরের তেল রপ্তানি বন্ধ করতে চায়। তখন জ্বালানিি তেল বহনকারী ২৪০টি তেলের ট্যাংকার আক্রান্ত হয়েছিল এবং ৫৫টি ডুবে যায়।

হরমুজ প্রণালি পরিচালিত হয় জাতিসংঘ সনদের আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইনের মাধ্যমে। আইন অনুযায়ী হরমুজ প্রণালি আন্তর্জাতিক প্রণালি। এর অর্থ সব দেশেরই ওই জলপথ দিয়ে নির্বিঘেœ যাতায়াতের অধিকার রয়েছে। তারপরও ওই অঞ্চলে ইরান ব্যাপক সামরিক ক্ষমতা বজায় রাখে। তারা ইচ্ছা করলে ওই জলপথ দিয়ে তেল পরিবহন বিঘিœত করতে পারে। কূটনৈতিক চাপের সময় তেল পরিবহনের নির্দিষ্ট জাহাজে ইরানের উঠে পড়ার একাধিক নজির রয়েছে।

২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যেও হরমুজ প্রণালি বন্ধের হুমকি দেয় ইরান। ওই সময়ে পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে দুই দেশের উত্তেজনার মধ্যে তেল পরিবহন বন্ধের হুমকি দিলে তেলের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়।

এদিকে, গত ১ এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানের দূতাবাসে বোমা হামলার প্রতিশোধ নিতে গত শনিবার রাতে ও রবিবার সকালে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে তিনশর বেশি ড্রোন-ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে তেহরান। এই হামলার মধ্য দিয়ে দীর্ঘ তিন দশকেরও বেশি সময় পরে মধ্যপ্রাচ্যে বড় আকারের সংঘাতের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে তেলের বাজারে। অপরিশোধিত তেলের দুই বেঞ্চমার্ক ব্রেন্ড ক্রুড এবং ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (ডব্লিউটিআই) উভয়ের দাম শতকরা হিসেবে কমেছে ১ শতাংশ বা তারও বেশি।

বাজার বিশ্লেষকদের মতে, সোমবার প্রতি ব্যারেল (১৫৯ লিটার) ব্রেন্টক্রুড বিক্রি হচ্ছে ৮৯ দশমিক ৪৬ ডলারে। শতকরা হিসাবে এই দাম গত রবিবারের তুলনায় ১ শতাংশ কম। আর প্রতি লিটার ডব্লিউটিআই বিক্রি হয়েছে ৮৪ দশমিক ৬১ ডলারে, যা আগের দিন রবিবারের তুলনায় শতকরা হিসেবে ১ দশমিক ২ শতাংশ কম।

বাজার পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো জানিয়েছে, বৈশ্বিক বাজারে জ্বালানি তেলের বৃহত্তম জোগান আসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। তাই আঞ্চলিক অস্থিরতা শুরু হলে জ্বালানি তেলের সরবরাহ রুটে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। ফলে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে এবং সেই অস্থিতিশীলতার প্রাথমিক লক্ষণ হলো সোমবারের মন্দাভাব।

প্রসঙ্গত, অপরিশোধিত তেলের আন্তর্জাতিক বাজারে ইরান গুরুত্বপূর্ণ বিক্রেতা দেশ। জ্বালানি তেলের উত্তোলন ও বিপণনকারী দেশগুলোর জোট ওপেক প্লাসের অন্যতম এই সদস্য রাষ্ট্রটি নিজেদের খনিগুলো থেকে প্রতিদিন কম-বেশি ৩০ লাখ ব্যারেল জ্বালানি তেল উত্তোলন করে।

জ্বালানি পণ্যের বাজার বিশ্লেষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এনার্জি আসপেক্টসের কর্মকর্তা অমৃতা সেন বলেন, ‘যদি মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা না কমে, তা হলে তার প্রভাব বৈশ্বিক জ্বালানি তেলের বাজারে পড়বে- তা খুবই স্বাভাবিক এবং এই প্রভাবের মাত্রা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের চেয়েও অনেক বড় হবে।’

এদিকে, জাতিসংঘে নিযুক্ত ইরানের দূত ও স্থায়ী প্রতিনিধি বলেছেন, ইসরায়েল পাল্টা হামলা চালালে ইরানের দ্বিতীয় প্রতিশোধটি হবে ‘সবচেয়ে সুনির্দিষ্ট’। গতকাল সোমবার আমির সাইদ ইরাভানি ব্রিটিশ টিভি নেটওয়ার্ক স্কাই নিউজকে এক সাক্ষাৎকারে এই মন্তব্য করেছেন।

ইসরায়েলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা ইরানের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য প্রতিক্রিয়া দেখানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রেক্ষাপটে এক প্রশ্নের জবাবে ইরাভানি বলেন, … এটা একটা হুমকি… কোনো পদক্ষেপ নয়। গত শনি ও রবিবারের হামলা প্রসঙ্গে ইরানি দূত বলেন, এই পদক্ষেপ ইরানের আত্মরক্ষার সহজাত অধিকারের চর্চা, যেমনটি বর্ণিত হয়েছে জাতিসংঘ সনদের ৫১ ধারায়। সিরিয়ায় ইরানি দূতাবাসে ইসরায়েলি হামলাকে তিনি জাতিসংঘ সনদের ২ (৪) ধারার লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করেন।