হজ আখেরাত সফরের এক বিশেষ নিদর্শন। হজ আল্লাহর ইশক ও মহব্বত প্রকাশের এক অনুপম বিধান। মুহাক্কিক আলেমগণ হজের সফরকে আখেরাতের সফরের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কেননা মানুষ যখন হজের উদ্দেশ্যে বের হয়, তখন আত্মীয়স্বজন, বাড়িঘর, বন্ধুবান্ধব ত্যাগ করে তারা যেন পরকালের সফরে বের হয়। মৃত্যুর সময় যেমন বাড়িঘর, ব্যবসা-বাণিজ্য ত্যাগ করতে হয়, অনুরূপভাবে হজের সময়ও এ জাতীয় সবকিছু বর্জন করতে হয়। যানবাহনে আরোহণ, হাজিকে খাটিয়ায় সওয়ার হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ইহরামের দুই টুকরো শ্বেতশুভ্র কাপড়, তীর্থপথের যাত্রীর মনে কাফনের কাপড়ের কথা জাগরূক করে দেয়। ইহরামের পর লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক বলা কিয়ামতের দিন আহ্বানকারীর ডাকে সাড়া দেওয়ার সমতুল্য। সাফা মারওয়া সায়ী, হাশরের ময়দানে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করার মতো। সেদিন যেমন মানুষ দিশাহারা হয়ে নবী-রসুলগণের কাছে দৌড়াদৌড়ি করবে, অনুরূপভাবে হাজিরাও সাফা মারওয়া পর্বতের মাঝামাঝি স্থানে দৌড়াদৌড়ি করে থাকেন। আরাফার ময়দানে লাখ লাখ মানুষের অবস্থান, হাশরের ময়দানের নমুনা বলে বোধ হয়। সূর্যের প্রচন্ড তাপের মধ্যে আশা ও ভয়ের এক করুণ দৃশ্যের অবতারণা হয় এ ময়দানে। এক কথায় হজের প্রতিটি আমল থেকেই আখেরাতের কথা ভেসে ওঠে হজযাত্রীর হৃদয়ে। এটাই হলো হজের প্রধানতম তাৎপর্য ও রহস্য। হজ হলো আল্লাহর ইশক ও মহব্বত প্রকাশ করার এক অপরূপ বিধান। অর্থাৎ প্রেমাষ্পদের আকর্ষণে মাতোয়ারা হয়ে প্রেমিক ছুটে চলে যায় জিয়ারতে বাইতুল্লাহর উদ্দেশ্যে। কখনো মক্কায়, কখনো মদিনায়, কখনো আরাফায়, আবার কখনো মুজদালিফায় উপস্থিত হয়ে হাজি কান্নাকাটি ও গড়াগড়ি করছেন মহান আল্লাহর দরবারে। বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ নেই তার কোথাও। এভাবে ছোটাছুটি করে উত্তপ্ত হৃদয়ের প্রশান্তি লাভ করতে সচেষ্ট। কেননা প্রেমাষ্পদের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া এবং তার তালাশে জঙ্গল পাহাড় পর্বত এবং সাগর-মহাসাগর পাড়ি দিয়ে পবিত্র মক্কা ও মদিনার অলিগলিতে দৌড়াদৌড়ি করা আল্লাহ প্রেমিকদের কাজ। ইহরাম বাঁধা প্রকৃত প্রেমিক হওয়ার এক জ্বলন্ত নিদর্শন। না আছে মাথায় টুপি, না শরীরে জামা, সুন্দর পোশাক, না আছে সুগন্ধি। বরং ফকিরের বেশে সদা চঞ্চল ও উদাসী মনে সেলাইবিহীন শ্বেতশুভ্র কাপড়ে আচ্ছাদিত হয়ে এক পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণকারী মুসলিমের কী অপূর্ব দৃশ্য। লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক বলতে বলতে ছুটে চলছেন তারা মক্কা মদিনার পানে। প্রভু বান্দা হাজির, হাজির আমি তোমার দরবারে, আমি অপরাধী ক্ষমা কর হে প্রভু। এই বলে কান্নাকাটি করে হাজি মক্কা ও মদিনায় পৌঁছে মনে প্রশান্তির আত্মতৃপ্তি লাভ করেন। আমি আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছে গেছি এবার তাঁকে আমি পাবই পাব। তাঁর বিচ্ছেদ আর সহে না দিলে। আমি তাঁর ভালোবাসার সমুদ্রে অবগাহন করব। নিজেকে পাক-পবিত্র করে নেব; কারণ বিচ্ছেদের অনলে দগ্ধ একটি অন্তর যখন প্রিয়তমের নৈকট্য লাভে ধন্য হয় তখন তার আবেগ সমুদ্র কত যে তরঙ্গায়িত হতে থাকে তা প্রেমপাগল ব্যতীত অন্য কারও বোঝা বড়ই দায়। আল্লাহর প্রেমিক আল্লাহর নিদর্শনগুলো নিজের চোখে দেখে, হাতে স্পর্শ করে পাগলের মতো হয়ে যায়। হাজরে আসওয়াদ চুমু খায়, মুলতাজাম জড়িয়ে ধরে, কাবার চৌকাঠ ধরে কান্নাকাটি করে, বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করা, হাতিমে কাবায় নামাজ আদায় করা, মাকামে ইব্রাহিমে নামাজ আদায় করা, এ যেন ইশক ইলাহির অনুপম দৃশ্য। ভালোবাসার চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটে জামরাতে কঙ্কর নিক্ষেপের সময়। কেননা প্রেমিকের আবেগ যখন চরমে পৌঁছে যায় তখন প্রেমাষ্পদকে লাভ করার পথে যত বাধাই আসুক না কেন, তাকেই আক্রমণ করে বসে এবং তার শত্রুতে পরিণত হয়। অতঃপর পশু কোরবানি করে প্রেমানুরাগের শেষ মঞ্জিল অতিক্রম করে। অতঃপর হজের সব কার্যক্রম শেষ করে প্রেমাষ্পদের বাড়ি ত্যাগ করে এবার বিদায়ের পালা, এ যে কঠিন মুহূর্ত। যাকে কাছে পাওয়ার জন্য পৃথিবীর সবকিছু ত্যাগ করে এলাম, তাঁর থেকেই বিচ্ছেদ- এ যেন মেনে নেওয়া কোনো প্রেমিকের পক্ষে অসম্ভব। কাবার মালিককে কীভাবে বিদায়ের কথা বলব, প্রেমাষ্পদের বাড়ি ছেড়ে পৃথিবীর আর কোথায় গিয়ে আমি আশ্রয় নেব, কোথায় গিয়ে সুখ খুঁজব। আমি তো সবকিছুই বিসর্জন দিয়ে এসেছি তোমার দরবারে হে আমার প্রভু। হে বিশ্ব প্রতিপালক। ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক তোমার পবিত্রতম দরবার আমাকে তো ছাড়তেই হবে। থেকে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তোমাকে বিচ্ছদের যন্ত্রণায় বাকি জীবনটুকু পার করা কতটা যে কঠিন হবে আমার জন্য। তোমার থেকে বিচ্ছেদ হয়ে নিজ আশ্রয়ে ফিরে গিয়ে জাগতিক কোলাহলে নিমজ্জিত হয়ে শয়তানের ধোঁকায় পুনরায় তোমার কাছে অপরাধী হয়ে যাব, সে জীবন যে আমি আর চাই না, সে জীবনের প্রতি মায়া-মোহ আর যে কিছুই অবশিষ্ট নেই। মৃত্যুর প্রহর গোনা ছাড়া আর কিছুই তো আমার চাওয়া-পাওয়ার নেই। তবুও যে যেতেই হবে, সেই পাপাচার জীবনে, বিধির বিধান অলঙ্ঘনীয়। অতঃপর হাজি সাহেব চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে বাইতুল্লাহর তাওয়াফে বিদা করে কান্নারত অবস্থায় বাইতুল্লাহ তথা পবিত্র মক্কা নগরীকে ত্যাগ করে আফসোস করতে করতে, ক্ষমা চাইতে চাইতে নিজ দেশে ফিরে আসেন। পবিত্র বাইতুল্লাহর মেহমান হাজি সাহেবগণ শিশুর ন্যায় নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসেন, আপন মুসাফিরখানার ক্ষণিকের আশ্রয়স্থলে। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে বাইতুল্লায় হজ করার তৌফিক দান করুন।
লেখক : ইমাম ও খতিব, কাওলার বাজার জামে মসজিদ, দক্ষিণখান, ঢাকা