ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যার রহস্যের জট খুলতে কসাই জিহাদকে নিয়ে কলকাতার সঞ্জীবা গার্ডেনের সেই ফ্ল্যাট পরিদর্শন করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) একটি দল।

সোমবার (২৭ মে) সকালে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশিদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি দল নিউ টাউনের ওই ফ্ল্যাটে প্রবেশ করেন। গত ১৩ মে এই সঞ্জীবা গার্ডেনের ‌‘বিইউ-৫৬’ ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটে এমপি আনারকে খুন করা হয়েছে বলে পুলিশের প্রাথমিক ধারণা। সেই রুমটিতে যান ডিবি প্রধান। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন সিআইডি কর্মকর্তারা ও নিউ টাউন থানার পুলিশ।

জিহাদকে সাথে নিয়ে প্রায় এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে ঘটনার বর্ণনা শুনেন তারা। এ সময় প্রতিনিধি দলের সামনে ঢাকা থেকে ভিডিও কলে যুক্ত করা হয় আমানুল্লাহ আমান ওরফে শিমুল সহ গ্রেফতারকৃত তিনজনকে। 

এ সময় তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানতে চান কোন পথ দিয়ে তারা ওই ফ্ল্যাটে প্রবেশ করেন, ফ্ল্যাটের কোন জায়গায় কোথায়-কিভাবে হত্যা করা হয়। খুনের পর লাশ কিভাবে টুকরো করা হয়, পরে কিভাবে সেই লাশের টুকরো বাইরে বের করা হয় তারা সবই বর্ণনা করেন। 

এ সময় ডিবি প্রধান প্রধান জানান, আমরা ক্রস এক্সামিন করেছি এবং সেখানে বেশ কিছু নতুন নতুন তথ্যও পেয়েছি। যদিও তদন্তের স্বার্থে তা বিস্তারিত বলতে রাজি হননি ডিবি প্রধান। 

জিহাদকে জিজ্ঞাসাবাদ করেই জানা যায় এমপি আনারের লাশ টুকরো টুকরো করে ফেলে দেওয়া হয় কলকাতার দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার ভাঙড়ের কৃষ্ণ মাটি বাগজোলা খাল ও সংলগ্ন এলাকায়। এরপর প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেও জিহাদকে নিয়ে সেই বাগজোলা খাল পরিদর্শনে যান ডিবি প্রধান হারুন। 

এ বিষয়ে ডিবি প্রধান হারুন অর রশিদ জানান, ‘আমরা দুইবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। অভিযুক্ত জিহাদকে টিআই প্যারেডের (Taste Identification Parade) জন্য ঘটনাস্থলে নিয়ে গেছি। আজ আমরা জিহাদকে নিয়ে আবারও এই বাগজোলা খালে যেখানে লাশ ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগ, সেখানে যাই। আমরা ভারতীয় পুলিশের সাথে কথা বলেছি। লাশ উদ্ধারের চেষ্টায় ভারতীয় পুলিশ যথেষ্ট কাজ করছে। আমরা তাদের পাশে আছি। লাশ উদ্ধারের ক্ষেত্রে তাদের যে আন্তরিকতা, একনিষ্ঠ প্রচেষ্টা তাতে আমাদের আশা স্বল্প সময়ের মধ্যে লাশের অংশ বিশেষ উদ্ধার করতে পারব।  

ডিবি প্রধান আরও জানান, ‘আমাদের একজন সংসদ সদস্যকে কলকাতায় হত্যা করা হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় এই ঘটনায় আমরা বাংলাদেশে কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছি। তাদের কাছ থেকে বেশ কিছু তথ্য পেয়েছি। কলকাতা পুলিশ একজনকে গ্রেফতার করেছে। যেহেতু এই ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল বাংলাদেশে এবং নিষ্পত্তি হয়েছে কলকাতায়, সে কারণে আমরা নিউ টাউন থানায় এসে এই মামলার তদন্তকারী অফিসারকে সাথে নিয়ে স্বাক্ষ্যগ্রহণের স্বার্থে আমরা কিছু place of occurrent (PO) ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। এবং যেই রুমে তাকে হত্যা সংঘটিত করা হয়েছিল সেই ঘরও পরিদর্শন করা হয়েছে।’

একজন পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে এই ধরনের বর্বরোচিত ঘটনা তিনিও কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেন। ডিবি প্রধানের অভিমত, ‘যেভাবে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছে সেটা একজন পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে আমি এটা মেনে নিতে পারছি না। একটা সভ্য সমাজে এত বড় নিষ্ঠুর বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড হতে পারে না। আমাদের এমপি আনারকে হত্যা করে তার লাশটাকে আলাদা করে ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনা মাফিক গুম করা হয়। এবং এই অপরাধকে ভিন্ন ধারায় নিয়ে যাওয়ার একটা প্রচেষ্টা করেছে। যে আলিশান বাড়িতে ঘাতকরা সংসদ সদস্যকে হত্যা করেছিল, আমাদের মনে হয় এখনও ঘাতকদের অট্টহাসি শুনতে পাচ্ছি, সংসদ সদস্যের কান্না শুনতে পাচ্ছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দুই দেশের পুলিশ কাজ করছে আমরা অবশ্যই অভিযুক্তদের গ্রেফতার করব এবং তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে এসে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাব।’

খুনের ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া একমাত্র নারী অভিযুক্ত শিলাস্তি রহমানের ভূমিকা নিয়ে ডিবি প্রধান জানান, ‘আমরা ভারতীয় অংশে তদন্ত করে দেশে ফিরে তারপর শিলাস্তি রহমানের সাথে কথা বলব। যে ফ্ল্যাটে হত্যাকাণ্ড হয়েছিল সেখানে তিনি ছিলেন কিন্তু সেক্ষেত্রে তার কি ভূমিকা ছিল, সেটা তার সাথে কথা বলেই জানা যাবে।’ 

ইতোমধ্যে এমপি আনারের কন্যা মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন যে প্রমাণের দাবি জানিয়েছেন তা নিয়ে ডিবি প্রধান জানান, ‘আমরা এই ঘটনায় স্তম্ভিত। এই ধরনের হত্যাকাণ্ড আমরাই মেনে নিতে পারছি না। তার যে কান্নার শব্দ বা বাঁচার আকুতি মিনতি করার শব্দ সেটা এখনো আমাদের কানে বাজছে। ওই রুমে ঢোকার পরে বা ঘাতকরা কিভাবে তাকে পৈশাচিকভাবে হত্যা করেছে সেই ঘটনা আমাদের চোখে ভাসছে। সে ক্ষেত্রে তার মেয়ের তো এই অনুভূতি হবেই।’ 

খুনের ঘটনায় কি ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল তা নিয়ে ডিবি হারুন অর রশিদ জানান, ‘এগুলো নিয়ে কাজ চলছে, আমরা পরে জানিয়ে দেব।’

পশ্চিমবঙ্গের সিআইডির কর্মকর্তাদের তদন্তের অগ্রগতির প্রশংসা করে হারুন অর রশিদ জানান, পশ্চিমবঙ্গের তদন্তকারী কর্মকর্তারা যেভাবে কাজ করছেন তাতে আমি সন্তুষ্ট। আমি নিশ্চিত যে পুরোপুরি না হলেও শিগগিরই তারা লাশের অংশ খুঁজে পাবেন।’ 

গতকাল রবিবার ডিবি প্রধান হারুন অর রশিদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের গোয়েন্দা প্রতিনিধি দল কলকাতা পৌঁছায়। সকালে নিউ টাউন থানায় যান ডিবি প্রধান। এ ঘটনা তদন্তকারী কর্মকর্তাকে সাথে নিয়ে ঘটনাস্থল সঞ্জীবা গার্ডেনে যান তারা। পরে সন্ধ্যায় কলকাতার ভবানী ভবনে অবস্থিত রাজ্য পুলিশের সদর দপ্তরে গিয়ে সিআইডি’র অতিরিক্ত মহাপরিচালক আর রাজাশেখরনের সাথে কথা বলেন। তাই গ্রেফতার কসাই জিহাদ হাওলাদারকেও তিন থেকে চার ঘণ্টা ক্রস-এক্সামিন করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ করে খুনের মোটিভ জানতে চান গোয়েন্দা প্রধান। 

তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে গোয়েন্দা প্রধান জানান, এটি একটি লম্বা প্রক্রিয়া। যেহেতু দু’টি দেশে অপরাধ সংগঠিত হয়েছে, তাই আমরা দুই দেশেই তদন্ত করছি। নিশ্চিত করে বলা সময় আসেনি যে ঠিক কি কারণে এই অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল।’